২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাঁশখালীতে বছরে ১০ লাখ কেজি চা পাতা উৎপাদনের লক্ষ্য

বাঁশখালীতে বছরে ১০ লাখ কেজি চা পাতা উৎপাদনের লক্ষ্য - নয়া দিগন্ত

আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে ১লাখ ৪০ হাজার মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন বৃদ্ধি করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে চা রফতানী করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার, সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাংলাদেশ চা বোর্ড গ্রহণ করেছে নানামুখী কার্যক্রম। এই কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে প্রতিটি বাগানে প্রতিবছর কমপক্ষে আড়াই শতাংশ করে চা বাগান বর্ধিত করা আর সেজন্য উন্নত মানের চারা প্রদান ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এর পাশাপাশি আনুসাঙ্গিক সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করায় প্রতি বছরই চা বাগানের পরিধি ও উৎপাদন দুটোই বাড়ছে।

সে কারণে ২০২৫ সালের আগেই বিদেশে চা রপ্তানী করার সম্ভবনা দেখছেন বাংলাদেশ চা বোর্ডের সদস্য সচিব কুল প্রদীপ চাকমা। তিনি বলেন, সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি নিদের্শনার আলোকে দেশের চায়ের চাহিদা মেটাতে পরনির্ভশীলতা কমিয়ে বরং উপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে চা রফতানী করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ চা বোর্ড। ইতোমধ্যে সরকারের সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে সমগ্র দেশের চা বাগানে পরিধি বৃদ্ধির সাথে চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধি করার কাজ চলছে।

জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ১৬৬ টি চা বাগানে ৬০ হাজার হেক্টর চাষযোগ্য জমি রয়েছে সেখানে প্রতিবছর গড়ে প্রতি হেক্টরে চা উৎপাদন হয় ১ হাজার ৫০০ কেজি অপরদিকে সমপরিমাণ জমিতে ইস্পাহানী, ফিনলে, ডানকানসহ বেশ কিছু বাগানে ২ হাজার ৫০০ কেজি থেকে ৩ হাজার কেজি। জানা গেছে, চলতি বছর উৎপাদনের লক্ষমাত্রা হলো – ৭৪ হাজার ১৪০ মিলিয়ন কেজি আর চলতি মৌসুমে আগস্ট পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে ৫২ হাজার ৫৫৭ মিলিয়ন কেজি।

২০১৮ সালে উৎপাদনের লক্ষমাত্রা ৭২ হাজার ৩৯০ মিলিয়ন কেজি থাকলেও তা ছাড়িয়ে উৎপাদন হয়েছে ৮২ হজার ১৩৪ মিলিয়ন কেজি। একইভাবে ২০১৭ সালে দেশে চা উৎপাদনের লক্ষমাত্র ৭০ হাজার ৬৮০ মিলিয়ন কেজি থাকলেও তা ছাড়িয়ে উৎপাদন হয়েছে ৭৮ হাজার ৯৪৯ মিলিয়ন কেজি।

অর্থ্যাৎ প্রতিবছরই দেশে চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গড়ে প্রতি বছর ৯ হাজার ৬৫ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে গত ২০১৭ ও ২০১৮ সালে। চা চাষের পরিধি ও উৎপাদন বৃদ্ধির কর্মযজ্ঞে পিছিয়ে নেই দক্ষিণ চট্টগ্রামের একমাত্র চা বাগান বাঁশখালীর চাঁদপুর বেলগাঁও বাগান মালিক কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, সিটি গ্রুপের মালিকানাধীন চাঁদপুর বেলগাঁও চা বাগানের মোট আয়তন ৩ হাজার ৪৭২.৫৩ একর। পাহাড়ী ছোট বড় টিলা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এই চা বাগানে এখন মাত্র ৬৩৮ একর জায়গায় চা বাগান রয়েছে, ওই বাগানে চলতি বছর উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার কেজি।

বাগানের ব্যবস্থাপক আবুল বাসার বলেন, এই চা বাগানের পরিধি ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কাজ শুরু করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, গত বছর এই বাগানে উৎপাদনের টার্গেট ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার এই বছর তা বেড়েছে। এখন চা বাগানের পরিধি বৃদ্ধি করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, বাগান কর্তৃপক্ষ বাগান সম্প্রসারণের জন্য কাজ করছেন। তিনি বলেন, বাগানের পরিধি বাড়িয়ে আগামীতে এই বাগান থেকে ১০ লাখ কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাঁশখালী উপজেলার পুকুরিয়া ইউনিয়নের পাহাড়ী জনপথ চাঁন্দপুর এলাকায় এই চা বাগানের অবস্থান। এই বাগানে পুরুষ মহিলাসহ বিভিন্ন ধর্মের ও বর্ণের প্রায় ৭০০ শ্রমিক বাগান থেকে চা পাতা তোলার কাজ করছে।

বাগানের ব্যবস্থাপক আবুল বাসার বলেন, দেশে ১৬৬ টি চা বাগানের মধ্যে বেলগাঁও চা বাগানের অবস্থান ৬ষ্ঠ।
এই বাগান, কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিষয়টি নিশ্চিত না হলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১৯১২ সালে ইংরেজরা ওই বাগানে প্রথম চা পাতা উৎপাদন শুরু করেন।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে মালিকানার অনুপস্থিতিতে অব্যবস্থাপনার সম্মুখীন হয়ে পড়ে চা বাগানটি। ক্রমান্বয়ে বাগানের অধিকাংশ জমি স্থানীয় অধিবাসীদের অবৈধ দখলে চলে যায়। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত হিন্দু জমিদারদের মালিকানায় ছিল, যার নাম ছিল রায় বাহাদুর। জমিদার রায় বাহাদুরের জন্ম ছিল কুন্ড পরিবারে। তাই এই বাগান পূর্বে কুন্ড চা-বাগান নামে খ্যাত ছিল।

১৯৬৫ সালে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে বাগানটি, অর্পিত চা-বাগান সমূহের চীফ কাস্টডিয়ান চা-বোর্ডের উপর ন্যস্ত করা হয়। পরবর্তীতে এনিমি প্রপার্টি ম্যানেজম্যান্ট বোর্ড (ইপিএমবি) গঠিত হলে বাগানটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ইপিএমবি এর উপর ন্যস্ত করা হয়।

১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর মিনিষ্ট্রি অফ ইন্ডাস্ট্রিজ এন্ড ন্যাচারাল রিসোর্স কর্তৃক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তৎকালীন ইপিএমবি এর ব্যবস্থাপনাধীন চাঁদপুর বেলগাঁও চা-বাগানটিসহ সবকটি পরিত্যক্ত চা-বাগানগুলো পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ চা-বোর্ডের আওতায় গঠিত বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রিজ ম্যানেজম্যান্ট কমিটির (বিটিআইএমসি) উপর ন্যস্ত করা হয়। কিন্তু ইপিএমবি ও বিটিআইএমসি কোনো প্রতিষ্ঠানই চা বাগানের অস্তিত্ববিহীন এ বেলগাঁও বাগানটির বেদখলীয় জমির দখল উদ্ধার করে চা-চাষাবাদ করতে পারেনি।
এ কারণে ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর বাগানটি পরিত্যক্ত অবস্থাতেই ছিল। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ চা-বোর্ড ক্ষুদ্রায়তন চা-চাষ প্রকল্প চালু করার উদ্যেশ্যে বাগানটির বাস্তব দখল চা-বোর্ডের নিকট হস্তান্তরের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের নিকট আবেদন করার মধ্য দিয়ে ওই সময়ে বাংলাদেশ চা-বোর্ড প্রায় ৮ একর জমির উপর চা-চাষ শুরু করে।

এরপরই এই চা-বাগানটি বাংলাদেশ চা-বোর্ড ১৯৯২ সালে রাগীব আলীর স্বত্বাধিকারী বাঁশখালী টি কেম্পানীর নিকট হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তিতে ২০০৩ সালে বাঁশখালী টি কোম্পানীর সমুদয় শেয়ার বেসরকারী সংস্থা ব্র্যাক ক্রয় করে কোম্পানী আইন ১৯৯৪ এর বিধান অনুযায়ী এ বাগানটিকে ব্র্যাক বাঁশখালী টি কোম্পানী লিঃ নামকরণ করা হয়। ব্র্যাক চা-বাগানটির মালিকানাস্বত্ব গ্রহণ করার পর ২০০৪ সালে বাগানের অভ্যন্তরে চা-কারখানা চালু করে এক নাগাড়ে ২০১৫ সাল পর্যন্ত চা উৎপাদন করে। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে এই বাগানটি ক্রয় করে নেয় সিটি গ্রুপ। বর্তমানে সিটি গ্রুপের অধীনে এই চা বাগানে পুরোদমে চা উৎপাদন চলছে।

বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনিস্টিটিউশনের পরিচালক ড. মোহাম্মদ আলী নয়া দিগন্ত অনলাইনকে বলেন, দেশে এখন ২১টি কোলোন ও ৫ টি উচ্চ ফলনশীল জাতের চা পাতার জাত রয়েছে। তিনি বলেন, সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে ১ লক্ষ ৪০ হাজার মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নিয়ে কাজ করছে সেই লক্ষ বাস্তবায়নে কাজ করছে বাংলাদেশ চা বোর্ড। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাও, নীলফামারী, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি এলাকায় আরো ১ হাজার ৬০০ হেক্টর নতুন বাগান সৃজন করা হয়েছে।

চা বোর্ডের সদস্য সচিব কুল প্রদীপ চাকমা বলেন, প্রতিবছর দেশে চা এর উৎপাদন লক্ষমাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সেই হিসাবে তিনি ২০২৫ সালের আগেই দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে চা রপ্তানী করার আশা প্রকাশ করছেন।


আরো সংবাদ



premium cement