২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

প্রবাসীর স্ত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু : আত্মহত্যা নাকি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড?

নিহত গৃহবধূ জান্নাতুন নাঈম সুখী ও অভিযুক্ত বখাটে হাসান - নয়া দিগন্ত

চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে প্রবাসী যুবকের স্ত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। নিহত গৃহবধূর নাম জান্নাতুন নাঈম সুখী। তিনি সৌদি প্রবাসী তৌকির আহমেদ রনির স্ত্রী। ঈদের আগেরদিন রোববার বিকেলে গৃহবধূ জান্নাতুন নাঈম সুখীর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। গৃহবধূ সুখীর মৃত্যু আত্মহত্যা নাকি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা রহস্যের। এদিকে এ ঘটনাকে ঘিরে নানা গালগল্প ও মুখরোচক কাহিনী ছড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে নিহত গৃহবধূর পরিবার।

ঘটনার বিবরণে জানা যায়, উপজেলার ওয়ারুক পাটওয়ারী বাড়ির মৃত ইউসুফ পাটোয়ারির ছেলে তৌকির আহমেদ রনি প্রায় ৩ বছর পূর্বে ভালোবেসে একই ইউনিয়নের রাড়া গ্রামের মশিউর রহমানের মেয়ে জান্নাতুন নাঈম সুখীকে বিয়ে করেন। বিয়ের দেড় মাস পরেই জীবিকার তাগিদে সৌদি চলে যান তৌকির। মেধাবী জান্নাত বিয়ের পরেও চাঁদপুর সরকারি কলেজে সমাজকর্ম বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন। পড়ালেখার প্রতি তার আগ্রহ ও একাগ্রতা দেখে সকলেই তার প্রশংসা করতো। পড়াশুনা, স্বামী ও পরিবার নিয়ে সুখে থাকা সুখীর জীবনে কি এমন ঘটনা ঘটেছিলো যাতে জীবনের সমাপ্তি টানতে হয়েছে- এ প্রশ্ন পরিবার, স্বজন ও সহপাঠীদের।

কি হয়েছিলো সেদিন?

গত ১১ আগস্ট রোববার ঈদের আগের দিন বেলা সাড়ে ৫টায় জান্নাতুন নাঈম সুখী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন বলে দাবি করে নিহতের শ্বশুর বাড়ির লোকজন। তাদের মতে, বখাটের উৎপাতে নিজের জীবনকে বিসর্জন দেয়াটাই শ্রেয় মনে করে আত্মহত্যার মতো জঘন্য পথ বেছে নিয়েছে সুখী। এ ঘটনায় প্রতিবেশী হাসানকে আসামী করে মামলা দায়ের করে নিহত গৃহবধূ সুখীর শ্বাশুড়ি পারুল বেগম। তবে এ নিয়ে এলাকাবাসীর মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিরাজ করছে।

সুখীর শ্বাশুড়ি পারুল বেগম জানান, ঈদের আগের দিন রোববার (১১ আগস্ট) দুপুর ১টায় তিনি ও তার জা আকলিমা হাজীগঞ্জ বাজারে ঈদের কেনাকাটা করতে যান। এ সময় পুত্রবধূ জান্নাত বাড়ির উন্মুক্ত গোসলখানায় গোসল করতে যান। তখন প্রতিবেশী বখাটে যুবক হাসান (২১) দেয়ালের ফাঁক দিয়ে জান্নাতের গোসলের দৃশ্য দেখে। পরবর্তীতে বখাটে হাসান সুখীকে কুপ্রস্তাব দেয়। বিষয়টি সুখী তার সৌদি প্রবাসী স্বামী রনিকে মোবাইল ফোনে জানায়। বিষয়টি শুনে রনি খারাপ ভাষায় তাকে গালমন্দ করলে সুখী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে বলে দাবি করেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, আমার ছেলে ফোন দিয়ে সুখীকে না পেয়ে আমার জা আকলিমার নাম্বারে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করে আমরা কোথায় আছি? তাৎক্ষণিক সে আমাকে বাসায় কাউকে পাঠিয়ে দেখতে বলে বাসায় সুখীর কি হয়েছে? আমি আমার এলাকার সোহেল পাটোয়ারী (৩২) নামের ছেলেকে ফোন দিয়ে আমার বাসায় যেতে বলি। সে তার স্ত্রী আঁখি আক্তারকে (২২) আমার বাসায় পাঠালে আঁখি আমার পুত্রবধুর লাশ সিলিংয়ের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। পরবর্তীতে এলাকার মানুষজন ফাঁস অবস্থা থেকে নামিয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমি হাজীগঞ্জ হতে পথিমধ্যেই হাসপাতালে গিয়ে আমার পুত্রবধূকে মৃত দেখতে পাই।

পরে শাহরাস্তি থানার এসআই মোজাম্মেল গৃহবধূ জান্নাতের লাশ উদ্ধার করে। চাঁদপুর মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে গত সোমবার ঈদের দিন বাদ আসর জানাযা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

লাশ নামানো নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য

গৃহবধূ সুখী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে ছড়ানো হলেও তার ঝুলন্ত লাশ কারা নামিয়ে হাসপাতাল নিয়েছিলো এ নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে। গৃহবধূ সুখীর পরিবারের পক্ষ হতে প্রথম দিন জানানো হয়, কে বা কারা তাকে গলায় ফাঁস দেয়া ঝুলন্ত লাশ নামিয়েছে তা তারাও জানেন না।

শুক্রবার বিকেলে পুনরায় ওই বাড়িতে গেলে সুখীর শাশুড়ি পারুল বেগম জানান, তার জা’র মেয়ে সুরভী ঝুলন্ত দেহের উপরের উড়না কেটে সুখীকে নামায়। ঘটনার সময় উপস্থিত প্রতিবেশী সোহেল পাটোয়ারী (৩২) বলেন, ঘটনার দিন অভিযুক্ত হাসানসহ আমি ঈদগাহ পরিস্কার করতে গিয়েছিলাম। অভিযুক্ত হাসান পাটোয়ারী বাড়িতে পানি খাওয়ার জন্য কলপাড়ে গিয়ে ফেরত আসেন এবং আমার সন্তানকে পানি আনার জন্য পুনরায় জগ নিয়ে পাঠায়। আমিসহ হাসান পানি খেয়ে আবার কাজে মনোযোগ দেই। কাজ শেষে তিনি বাড়ি চলে যান। কিন্তু হাসান আরো কয়েকজন বন্ধুসহ ঈদগাহে অবস্থান করে।

পরবর্তীতে বিকেল সাড়ে ৫টায় সুখীর চাচী শাশুড়ী আকলিমা বেগম যখন তাকে ফোন দিয়ে তাদের বাসায় যেতে বলেন, তখন সে তার স্ত্রী আঁখিকে পাঠালে সে (আঁখি) সুখীর ঝুলন্ত লাশ দেখতে পায়। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি এসে সুখীকে ফ্লোরে শোয়া অবস্থায় পেলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাই। আমিসহ তানভী ও ফাতেমা নামক আরও দুজন মহিলা আমার সাথে সিএনজি যোগে হাসপাতালে যান। পরবর্তীতে ভয় পেয়ে আমরা লাশ ফেলে চলে আসি।

পানি খাওয়ার সময় হাসানের কাছে সেই সময় কোনো মোবাইল ছিলো না বলে তিনি দাবি করেন। ভিডিও ক্লিপের যে ঘটনার কথা আমরা শুনেছি তা বানোয়াট। কাছের হাসপাতালে দ্রুত না নিয়ে দূরবর্তী হাসপাতালে কেন সুখীকে নিতে গেলেন? সোহেলকে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি এটির সদুত্তর দিতে পারেননি।

নিহত গৃহবধূ সুখীর মা শাহনাজ পারভীন আক্ষেপ করে বলেন, আমার মেয়েটা দুনিয়া হতে চলে গেছে, অথচ তার মৃত্যুর সময়কালীন ঘটনাটা পর্যন্ত আমরা জানতে পারছি না। তার ঝুলন্ত লাশ বের করা কিংবা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার লোকগুলো কে?

নিহতের শাশুড়ি ও চাচী শাশুড়ি এ প্রতিবেদকের সাথে কথা বলার সময় বিভিন্ন লোকদের নিকট ফোন দিয়ে প্রতিবেদককে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেন ও বিষয়টি লুকাতে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে থাকেন।

নিহত গৃহবধূ সুখীর শরীরে আঘাতের চিহ্ন

গৃহবধূ সুখী আত্মহত্যা করেছে বলে নিহতের শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও সুখীর ঠোঁটে আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়। একটা মেয়ে নিজে আত্মহত্যা করলে তার মুখে বা ঠোটে আঘাতের দাগ কোত্থেকে আসবে এমন প্রশ্ন করে ঘটনাস্থলে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে সুখীর সহপাঠীরা। এ প্রশ্নকে ঘিরে স্বজনদের অনেককে দাঁড়িয়ে অশ্রুপাত করতে দেখা যায়।

সুখীর বান্ধবী শিখা জানান, সুখী মেয়েটি সরলমনা ছিল। সব বিষয়ে সে সৃষ্টিশীল মানসিকতার অধিকারী ছিল। সব সময় সে আমাদেরকে কোন ঝামেলা হলে তা সমাধানের উপায় বুঝাতো। সেই মেয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করবে তা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

ঘটনার নেপথ্যে...

গৃহবধূ সুখীর মৃত্যুর ঘটনায় ওয়ারুকে অবস্থিত হাসপাতালে দ্রুত চিকিৎসা না করিয়ে পার্শ্ববর্তী উপজেলার হাসপাতালে নেয়ার কারণ কি শুধুই কালক্ষেপণ নাকি লোক দেখানো তা নিয়ে এলাকায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া বিরাজমান। ঘটনার ২ দিন আগে রাত ১২টায় জানালার পাশে অভিযুক্ত বখাটে হাসান সুখীর নাম ধরে ডাকাডাকি করে। এতে শাশুড়ি পারুল বেগম শুনতে পেয়ে ধমক দিলে সে চলে যায়। এরপরও অভিভাবকহীন বাড়িতে সুখীকে একা রেখে যাওয়া ও ফ্রি স্টাইলে হাসানের এ বাড়িতে প্রবেশের বিষয়টি সুখীর শ্বশুরবাড়ির দায়িত্বহীনতা বলে মনে করছেন এলাকার লোকজন।

ঘটনার দিন সুখীর আপন ছোট ভাই সুখীর শ্বশুরবাড়িতে বেলা ১২ টার দিকে প্রবেশ করতে চাইলে বখাটে হাসানসহ আরও ৩ জন ছেলে তাকে বাধা দেয়। অভিযুক্ত হাসান কেন সুখীর ভাইয়ের পথরোধ করে তাকে বোনের বাড়িতে যেতে দিল না? সেদিনই সুখীর মৃত্যর ঘটনাটি রহস্যময় বলে দাবি তার পরিবারের।

তাছাড়া সুখীর ননদ ইতি হাজীগঞ্জে স্বামীর বাড়িতে থেকে ধর্ষণ শেষে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে মর্মে বান্ধবীদের জানালো কিভাবে?

সুখীর ননদের স্বামী কাসেম বিষয়টি আত্মহত্যা বলে গণমাধ্যমে প্রচারে তথ্যদানে বেশ উৎসাহী পরিলক্ষিত হয়েছে এবং তিনিই সরাসরি গণমাধ্যমকর্মীদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন বলে ৩/৪ জন গণমাধ্যমকর্মী জানিয়েছেন।

নামপ্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন জানান, সুখীর শাশুড়ি পারুল বেগম ও চাচী শাশুড়ী আকলিমা বেগমের নামে-বেনামে লোন (ঋণ) উঠানো আছে। যার ফলে তাদের বাড়িতে অনেক সংস্থার কর্মী প্রতিদিন আসা-যাওয়া করতো। পুরুষ শূন্য বাড়িতে এতো মানুষের আনাগোনাটা কি খুব ভালো চোখে দেখা যায়? বিদেশে থাকা সন্তান ও স্বামীর অর্থ কি অপ্রতুল ছিলো তাদের জন্য। তারা কেনইবা এতে অর্থ লেনদেনে নিজেদেরকে জড়িয়েছেন।

সুখীর মোবাইলে কি ছিল?

সুখীর মোবাইলে কি ছিল তা নিয়ে নানা প্রশ্নের জট ঘুরপাক খাচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তার এক সহপাঠী বলেন, লাশ বাড়িতে আনার পর আমরা কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব তার বাসায় গিয়েছিলাম। লাশ গোসলের সময় তার ব্যবহৃত মোবাইলটা আমরা সুখীর শ্বশুরবাড়ির লোকদের হাতে দেখে নিজেদের হাতে নিতে চাইলে তারা গড়িমসি করতে থাকে। পরে ঠিক ৩০ মিনিট পরে যখন তারা মোবাইলটি আমাদের হাতে দেন, তখন মোবাইলটি ভাঙ্গা দেখতে পাই। কি লুকানোর জন্য সুখীর মোবাইলটি ভাঙ্গা হয়েছে?

সুখীর স্বামী তৌকির আহমেদ রনি মোবাইল ফোনে জানান, ঘটনার সময় আমি সুখীর ফোনে ভিডিও কল দিলে কেউ একজন হট্টগোল থাকা অবস্থায় ফোন রিসিভ করে। আমি ভিডিও কলে সব কিছু দেখছিলাম ও শুনছিলাম। তার মানে ফোনটি তখনও সচল ছিলো। তবে পরবর্তীতে কে বা কারা মোবাইল ভাঙ্গলো। ভাঙ্গা মোবাইলের রহস্য উদঘাটন করতে পারলে অবশ্যই আরও তথ্য বেরিয়ে আসবে।

আমার মেয়ে আত্মহত্যা করতে পারে না

সুখীর মা শাহনাজ পারভীন জানান, আমার মেয়ের সাথে ঘটনার দিন বেলা ৩টার সময় আমার শেষ কথা হয়। মেয়ে আমাকে গোসলে যাওয়ার কথা বলে ফোনটি রাখে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে ৪ টা ১০ মিনিট পর্যন্ত অনলাইনে কথোপকথন হয়। বিকেল সাড়ে ৫টায় মেয়ের জামাই রনি আমাকে সুখীর মারা যাওয়ার খবর দিলে আমি তা বিশ্বাস করতে পারিনি। তবে আমি নিজে হাসপাতালে গিয়ে কাউকে লাশের সাথে পাইনি। পরবর্তীতে মেয়ের শাশুড়ি ও চাচী শাশুড়িকে হাসপাতালের বাইরে দেখতে পাই।

তিনি আরও বলেন, আমার ছেলে সেদিন সুখীর বাড়িতে যেতে চাইলেও অভিযুক্ত হাসান তাকে সেখানে যেতে বাধা দেয়। কেনইবা আমার শান্ত স্বভাবের মেয়ে আত্মহত্যা করতে গেলো। তা আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। আমার মেয়ে আত্মহত্যা করতে পারে না। সেদিন কি হয়েছে আমি জানতে চাই। আমার মেয়ের মোবাইল কে ভেঙ্গেছে? আমি মেয়েকে ফেরত পাবো না, কিন্তু আর কারও মেয়ের সাথে যেন এমন না হয় বলেই তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

শাহরাস্তি থানার ওসি মোঃ শাহআলম জানান, এ ঘটনায় নিহত জান্নাতুল নাঈমের শাশুড়ি পারুল বেগম বখাটে হাসানকে অভিযুক্ত করে থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযুক্ত বখাটে হাসানকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চলছে। নিহত সুখীর লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে এটা আত্মহত্যা নাকি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড তা নিশ্চিত হওয়া যাবে।


আরো সংবাদ



premium cement