১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
চরশরত এন এম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

শিক্ষক বাবা-মেয়ে-জামাই, ক্লাস নেন দফতরি!

শিক্ষা
চরশরত এন এম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকটে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। - ছবি : নয়া দিগন্ত

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের উপকূলীয় অঞ্চলের ৪৮ নন্বর চরশরত এন এম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকটে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। বিদ্যালয়ের কাগজে কলমে সাতটি পদের মধ্যে চারজন শিক্ষক থাকলেও একজন ডেপুটেশনে অন্য বিদ্যালয়ে চলে গেছেন। কর্মরত তিনজন শিক্ষকের মধ্যে সম্পর্ক বাবা-মেয়ে ও মেয়ের জামাই। তারাও ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করায় প্রায়ই ক্লাস নেন বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণী পাস দফতরি। এলাকাবাসীর অভিযোগ শিক্ষকদের উপস্থিতি নিয়ে কিছু বললেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খারাপ আচরণ করে।

সরেজমিনে বিদ্যালয়ে গেলে বিদ্যালয়ের নিচে দাঁড়িয়ে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আকাশ চন্দ্র দাসের সাথে কথা হয়। আকাশ জানায়, তাদের বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকটের কারণে ঠিকভাবে পড়ালেখা হয় না। কখনো কখনো প্রথম ও তৃতীয় শ্রেণীর ক্লাস নেন বিদ্যালয়ের দফতরি রাজীব চন্দ্র দাস।

১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত চরশরত এন এম সরকারি প্রথামকি বিদ্যালয়ে দ্বিতলায় গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ডালিম চন্দ্র দাস প্রশাসনিক কাজে বিদ্যালয়ের বাইরে রয়েছেন। জানা যায়, কামরুজাহান নামে আরেক শিক্ষক ডেপুটেশনে অন্য বিদ্যালয়ে কর্মরত। বিদ্যালয়ে আছেন বাকি দুইজন শিক্ষক বিমল চন্দ্র দাস ও চিনু রানী দাস। তারা সম্পর্কে বাবা-মেয়ে, আর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ডালিম চন্দ্র দাস শিক্ষক বিমল চন্দ্র দাসে মেয়ের জামাই।

দফতরি রাজীব চন্দ্র দাসকে দিয়ে ক্লাস নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষিকা চিনু রানী দাস প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে তা স্বীকার করে বলেন, ‘আপনার যা খুশি লেখেন’।

শিক্ষক বিমল চন্দ্র দাস জানান, বিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রায় ১৬০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। দুই তিনজন শিক্ষক দিয়ে ছয়টি ক্লাস নেয়া সম্ভব হয় না। কোনো কোনো সময় দুইজন শিক্ষক বিভিন্ন কারণে বিদ্যালয়ে না এলে ওই সময় রাজীবকে দিয়ে ক্লাস নেয়া হয়।

বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী বিপন দাস, রাজু দাস, পুষ্পিতা রানী দাস, চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী যথী রানী দাস জানায়, তিনজন শিক্ষকের মধ্যে দুইজন শিক্ষক কোনো কারণে বিদ্যালয়ে না এলে বিদ্যালয়ে আসা শিক্ষক তাদেরকে পড়া দেখিয়ে দিয়ে চলে যান। এসময় রাজীব স্যার (দফতরি) এসে তাদের পড়া নেন।

তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী ঈষান চক্রবর্তী, তৃষ্ণা দাস জানায়, যখন শিক্ষক থাকে না তখন দফতরি রাজীব দাস তাদের ক্লাস নেয়।

দফতরি রাজীব চন্দ্র দাসও স্বীকার করেন, তিনি কখনো কখনো প্রথম শ্রেণীর ও তৃতীয় শ্রেণীর ক্লাস নেন। আবার শিক্ষকরা ছাত্রদের পড়া দেখিয়ে দিয়ে তাকে দায়িত্ব দিয়ে অন্য ক্লাসে অথবা বাইরে চলে যান। তিনি ক্লাস নিতে পারেন কি না তার কোনো উত্তর দিতে পারেননি।

স্থানীয় রাম চন্দ্র দাস, কৃষ্ণ দাসসহ একাধিক অভিভাবক অভিযোগ করেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে তিনজনই একই পরিবারের। ফলে তারা নিজেরা তাদের ইচ্ছেমতো বিদ্যালয়ে আসেন এবং যান। বিদ্যালয় এলাকায় বাড়ি হওয়ায় বিদ্যালয় চলাকালে তারা কেউ কেউ বাড়িতে গিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করেন। ফলে বিদ্যালয়ে কোনো পড়ালেখাই হচ্ছে না। পড়ালেখা না হওয়ার কারণে চলতি বছর ৩০ জন শিক্ষার্থী পাশ্ববর্তী হাশিমনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলে গেছে। বিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষক এলেও ওই তিনজনের দুর্ব্যবহারের কারণে শিক্ষক থাকতে পারে না।

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি বাবুল দাস অভিযোগ করেন, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের কোনো আয়-ব্যয় পরিচালনা করেন না। তিনি তার ব্যক্তিগত হিসাব থেকে লেনদেন করে আয়-ব্যয় করেন। ফলে আয়-ব্যয়ের কোনো হিসেব নেই। সম্প্রতি পুকুরের মাছ বিক্রি, বিদ্যালয়ের গাছ বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন।

চরশরত এন এম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটি বর্তমান সভাপতি রাখাল চন্দ্র দাস জানান, আমাদের বিদ্যালয়ে শিক্ষকের নাম থাকলে কিন্তু তিনি ডেপুটেশনে অন্য বিদ্যালয়ে চাকরি করবেন, তা হয় না। শিক্ষক সংকটে আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা হচ্ছে না। তিনি শিক্ষক সংকট সমাধানে কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এছাড়াও জানান, বিদ্যালয়ের উন্নয়ন পরিচালনায় একটি ব্যাংক একাউন্ট রয়েছে। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক টাকা-পয়সা ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করেন না এবং তিনি কাউকে হিসেবও দেন না।

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চরশরত এন এম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ডালিম চন্দ্র দাসের কাছে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিদ্যালয়ের বিষয়টি আপনাকে দেখার দায়িত্ব কে দিয়েছে। সেটা দেখার জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসারসহ অনেকেই রয়েছে।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গোলাম রহমান চৌধুরী জানান, ওই বিদ্যালয়ের মৌখিক ডেপুটেশনে থাকা শিক্ষিকা কামরুজ্জাহানের ডেপুটেশন বাতিল করা হবে। বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট থাকলেও কোনো অবস্থায় দফতরি ক্লাস নিতে পারবে না। বিদ্যালয় চলাকালে কোনো শিক্ষক বিদ্যালয়ের বাইরে থাকতে পারবে না। এমনটি হলে তিনি খোঁজ-খবর নিয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নিবেন।


আরো সংবাদ



premium cement