১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সীমান্তে ভারী অস্ত্রে বর্মি সেনা

সীমান্তে ভারী অস্ত্রে বর্মি সেনা - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে আবারো টহল শুরু করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। অন্য দিকে মংডু ও বুচিডং জেলা শহর ও আশপাশের রোহিঙ্গা পল্লীতে টহল জোরদার করেছে নৌবাহিনী, পুলিশ ও বিজিপি। ফলে আতঙ্কে কাটছে রোহিঙ্গাদের সময়। এ দিকে কয়েক দিন ধরে পার্বত্য জেলা বান্দরবানের রুমা থেকে শুরু করে টেকনাফ পর্যন্ত সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে ভারী অস্ত্রসহ নতুন করে সেনাসংখ্যা বৃদ্ধি করেছে মিয়ানমার। এতে স্থানীয় বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে আবারো আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। 

বান্দরবানের থানছি ও আলীকদম সীমান্ত, নাইক্ষ্যংছড়ির চাকঢালা, আশারতলি, তুমব্রু ও ঘুমধুম সীমান্তে সেনা সদস্য ছাড়াও সীমান্ত পুলিশ-বিজিপির সদস্য সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। তারা অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে বান্দরবানের তুমব্রু বাইশফাঁড়ি সীমান্ত দিয়ে হেঁটে যায়। এ সময় তারা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সীমান্তের জিরো পয়েন্টে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের পর্যবেক্ষণ করে। এতে জিরো পয়েন্ট এলাকায় অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। 
এ বিষয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কক্সবাজারে সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবদুল খালেক জানান, মিয়ানমার পুরো সীমান্তেই হঠাৎ করে সেনাসংখ্যা বৃদ্ধি করে নিরাপত্তা বাড়িয়েছে। তাদের কাছে যে খবর রয়েছে, তাতে আগামী ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরসা নতুন করে হামলা করতে পারে এমন খবর তাদের মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে। এর সূত্র ধরেই মিয়ানমার হয়তো সীমান্তে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে থাকতে পারে। তবে বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবিও সতর্ক অবস্থায় থেকে নিরাপত্তা জোরদার করেছে। কিছু কিছু জায়গায় বিজিবির সদস্য সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে।

তবে এ পরিস্থিতিতেও সীমান্তে উত্তেজনা নেই বলে বিজিবির এই কর্মকর্তা জানান। তিনি আরো বলেন, সীমান্তে যথারীতি দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে নিয়মিত যৌথ টহল অব্যাহত রয়েছে।
এ দিকে তুমব্রু সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডের রোহিঙ্গা আবদুর রহমান জানান, শুক্রবার সকাল থেকে সীমান্তে সেনাদের টহল দেখা যাচ্ছে। কয়েক দিন আগেও এ পরিস্থিতি ছিল না। অনেক স্থানে ভারী ও হালকা অস্ত্র নিয়ে সেনা সদস্যরা টহল দিচ্ছে। বিজিপির সদস্য সংখ্যাও জিরো লাইনের কাছে বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া সীমান্ত থেকে রোহিঙ্গাদের সরে যাওয়ার জন্য আগের মতোই তারা মাইকিং করছে। রোহিঙ্গা আলী আহম্মদ জানান, দুই দিন থেকে সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ও টহল বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। তাদের ওপর হামলা হতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন নো ম্যানস ল্যান্ডের অনেক রোহিঙ্গা।

রোহিঙ্গারা জানান, আগামী ২৫ আগস্ট নিরাপত্তা বাহিনীর স্থাপনায় নতুন করে হামলা হতে পারে এমন গুজব ছড়ানো হয়েছে মিয়ানমারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সংবাদমাধ্যম এ গুজব ছড়িয়েছে।
রোহিঙ্গাদের কোরবানির গরু লুট : মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্যরা কোরবানির পশুহাট থেকে রোহিঙ্গা কৃষকের গরু লুট করা শুরু করেছে।
স্থানীয় সূত্র মতে, গত শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে একদল বিজিপি সদস্য মংডু টাউনশিপের কুলাপাড়া গ্রামের গরু বাজারে আসে।

বিজিপি সদস্যরা রোহিঙ্গা কৃষকদের বিভিন্ন রকম হুমকি-ধমকি দিয়ে ১০টি গরু জোর করে লুট করে নিয়ে গেছে। প্রতিটি গরুর দাম ১০ লাখ মিয়ানমারের টাকা (কিয়াট) বলে জানিয়েছেন স্থানীয় রোহিঙ্গারা। ভুক্তভোগী একজন রোহিঙ্গা কেঁদে কেঁদে বলেন, পুরো বছর পরিশ্রম করে আমি গরুটিকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছি, যাতে ওটা বিক্রি করে কিছু টাকা আয় করতে পারি। এখন আমাকে অনাহারে থাকতে হবে। এটিই আমার একমাত্র সম্বল ছিল।
বিজিপির চাঁদাবাজিতে রোহিঙ্গারা অতিষ্ঠ : বুচিডং জেলার ইয়ংশং ঘাঁটির বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্যদের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন স্থানীয় রোহিঙ্গারা। কোনো নোটিশ ও নির্দেশনা ছাড়া রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে ঢুকে তল্লাশির নামে লুটপাটও করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, সেনা-পুলিশ ও বিজিপি রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির খবর নতুন নয়। তার পরও অসহনীয় মাত্রায় চাঁদা দাবি করায় ইয়ংশং এলাকার রোহিঙ্গারা অতিষ্ঠ। বিশেষ করে তিনডিং পিঁয়ে গ্রামের রোহিঙ্গারা বিজিপিকে কিয়াট দিতে দিতে নিঃস্ব।

গত এক সপ্তাহে ৫০ লাখ মিয়ানমারের টাকা (কিয়াট) চাঁদা বিজিপির হাতে তুলে দিতে হয়েছে গ্রামটির রোহিঙ্গাদের। চাঁদা দিতে কেউ অপারগ হলে তাকে বেধড়ক মারধর করছে বিজিপি সদস্যরা।
এনভিসি না থাকলে, ঘরে মোবাইল থাকলে, বসতঘর সংস্কার করলে, বসতভিটার বাউন্ডারি দিলে এমনকি কারো ঘরে মেহমান এলেও অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করে বিজিপি। এ অপরাধের শাস্তি হিসেবে বিশাল অঙ্কের চাঁদা দাবি করে তারা।

ভোক্তভুগিরা জানিয়েছে, একবার চাঁদা দিলে ক্ষান্ত হয় না বিজিপি। দফায় দফায় তাদের দাবিকৃত অর্থ রোহিঙ্গাদের দিতে হয় । অন্যথায় শারীরিক নির্যাতন ও আটকের ভয় দেখানো হয়।
বিনা পারিশ্রমিকে রোহিঙ্গাদের শ্রমদানে বাধ্য করা হচ্ছে : গত বছরের আগস্টে সেনাবাহিনীর গণহত্যার মুখেও যেসব রোহিঙ্গা মাটি কামড়ে রয়ে গেছে তারা বিভিন্নভাবে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে বুচিডংয়ের রোহিঙ্গাদের দৌড়ের ওপর রেখেছে সেনা কর্তৃপক্ষ। নানা কৌশলে নির্যাতন ও বৈষম্য চলছে রোহিঙ্গাদের ওপর বিনা পারিশ্রমিকে রোহিঙ্গাদের শ্রমদানে বাধ্য করছে সেনাবাহিনী।
সূত্র জানিয়েছে, বুচিডংয়ের বিভিন্ন গ্রামের রোহিঙ্গাদেরকে ধরে নিয়ে গিয়ে সেনাবাহিনী কৃষি জমিতে কাজ করতে বাধ্য করছে। সারা দিন কাজ করালেও কোনো পারিশ্রমিক দেয়া হয় না রোহিঙ্গাদের। এমনকি খাবারো সরবরাহ করা হয় না। ফলে ক্ষুধার্ত পেটে কাজ করে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

বুচিডংয়ের কিংদং, আড্ডুইং ন্যাগাদি, ওকেহ্লা পিঁয়ে, ডাপ্পু চুং, কুন্তু এবং ইয়াকনু থিং গ্রামে জোরপূর্বক শ্রম আদায় করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে। প্রত্যেক রোহিঙ্গা পরিবার থেকে একজন সদস্য সেনাবাহিনীর কৃষি কাজে বাধ্য করছে কর্তৃপক্ষ। নির্দেশ অমান্য করলে ড়্রফেতারের হুঁশিয়ারিও রয়েছে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে।

২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর গণহত্যার পর থেকে রোহিঙ্গাদের জীবিকায়নের পথরুদ্ধ করে কর্তৃপক্ষ। ফলে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে খাদ্যাভাব চলছে। ধীরে ধীরে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হচ্ছে তারা। এর ওপর বিনাপারিশ্রমিকে শ্রমদানে রোহিঙ্গাদের কোনো ইচ্ছা নেই। কিন্তু প্রাণের ভয়ে সেনাবাহিনীর কৃষি ফার্মে যেতে হচ্ছে তাদের।

পাঁচটি গ্রামের রোহিঙ্গাদের এক গ্রামে অবরুদ্ধ : উত্তর আরাকানের বুচিডং জেলার পাঁচটি গ্রামের রোহিঙ্গাদের এক গ্রামে অবরুদ্ধ করার পরিকল্পনা করেছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি ও সেনাবাহিনী। গ্রামগুলোতে আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) প্রবেশ করতে পারেÑ এমন অজুহাতে গ্রামের বাসিন্দাদের সরে যেতে নির্দেশনা দিয়েছে প্রশাসন।
রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, বুচিডং উপজেলার তংবাজার, মিনগিছি, খানসামা, দাবাইংছড়া ও চৌপ্রাং গ্রামের রোহিঙ্গাদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করেছে বিজিপি ও সেনা কর্তৃপক্ষ। বৈঠকে বিজিপি ও সেনাকর্মকর্তা বলেছেন, ‘গ্রামগুলোতে আরসা প্রবেশ করে আত্মগোপন কিংবা হামলা করতে পারে। তাই এই পাঁচটি গ্রামের বাসিন্দাদের একটি গ্রামে স্থানান্তর হতে হবে।’

বৈঠকে অংশগ্রহণকারী রোহিঙ্গারা কর্তৃপক্ষের সাথে বিতণ্ডা না করলেও, তাদের দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরেছে। ওই পাঁচ গ্রামের রোহিঙ্গাদের একটি গ্রামে অবরুদ্ধ করে রাখতে চায় কর্তৃপক্ষ।
এ দিকে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি, তল্লাসি এবং এক গ্রামে স্থানান্তরের নির্দেশনা পাওয়ার পর থেকে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে স্থানীয়দের মনে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক গণহত্যা চালায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ মিলিশিয়ারা। এতে কমপক্ষে ২৪ হাজার রোহিঙ্গা নিহত এবং ১৮ হাজার রোহিঙ্গা নারী ধর্ষিত হন। পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন প্রায় ১১ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কোরবানির গোশত দেবেন শেখ হাসিনা : বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদেরকে প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার উদ্যোগে আসন্ন ঈদুল আজহার কোরবানির গোশত দেয়া হবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের। আশ্রিত এক লাখ ৯৫ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের মধ্যে শেখ হাসিনার ঈদ উপহার কোরবানির গোশত বিতরণ করা হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় প্রশাসন। 
গত বছর কোরবানির ঈদ উৎসব চলাকালীন মিয়ানমারের সেনা নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন ১১ লাখ রোহিঙ্গা । 

কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনার নির্দেশে ঈদে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গোশত সরবরাহের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগণের কাছেও গোশত বিতরণ করা হবে। গোশত সরবরাহের জন্য ১০-১৫ হাজার পশুর প্রয়োজন হতে পারে। এই কাজে সরকারি তহবিল ছাড়াও বিভিন্ন দাতাসংস্থা ও এনজিওগুলোর কাছ থেকে সহায়তা নেয়া হয়েছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সুষ্ঠুভাবে গোশত বিতরণ এবং শৃঙ্খলা বিধানের জন্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি মনিটরিং সেলও গঠন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
শরণার্থীর প্রভাব সম্পর্কিত গবেষণা প্রতিবেদন : কক্সবাজারের স্থানীয় অধিবাসীদের ওপর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রভাব সম্পর্কিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষণাপত্রে মিয়ানমার জনগোষ্ঠীর আগমনের ফলে কক্সবাজারের স্থানীয় জনসাধারণের শিক্ষা-স্বাস্থ্য, কৃষি ও পরিবেশের কি ক্ষতি হয়েছে তার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল সোমবার কক্সবাজার সিএসও এনজিও ফোরাম (সিসিএনএফ) এবং কোস্ট ট্রাস্টের উদ্যোগে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।


আরো সংবাদ



premium cement