২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

৬ বছর পর ঈদের নামাজ পড়তে পেরে খুশি রোহিঙ্গারা

৬ বছর পর ঈদের নামাজ পড়তে পেরে খুশি রোহিঙ্গারা - ছবি : নয়া দিগন্ত

মিয়ানমারে নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগই মুসলিম। ভয়াবহ গণহত্যার মুখে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ঈদের অর্থই ভুলে গেছে। জীবন বাঁচাতে যারা ছুটছে পঙ্গপালের মতো তাদের জীবনে আবার ঈদ কিসের? এমনই প্রশ্ন ছিল রোহিঙ্গা শরণার্থীদের। রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতা আবু ছৈয়দ বলেন, স্বদেশে ঈদ উদযাপনের সঙ্গে নির্যাতন-নিপীড়নের মুখে পালিয়ে আশ্রয় নেয়া মানুষের ভিনদেশের ভিন্ন পরিবেশে ঈদের আমেজ উপভোগ কখনো এক হওয়ার কথা নয়। এখানে সাহায্য সহানুভূতি পেলেও ভুলতে পারেননি জন্মভূমির অতীতের সেইসব দিনগুলো।

রোহিঙ্গারা দীর্ঘ দিন ধরে মিয়ানমারে জাতিগত নির্যাতন-নিপীড়নের পাশাপাশি নাগরিক অধিকার বঞ্চিত। এই নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে অন্তত ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। তবে এবার বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে জামায়াতের সাথে ঈদের নামাজ পড়তে পেরে খুশি রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন রোহিঙ্গারা। শিশু–কিশোর থেকে শুরু বড়রা পর্যন্ত নিজেদের সবচেয়ে ভালো পোশাকটা পরেই নামাজ আদায় করেছেন।

শনিবার সকাল আটটায় উখিয়ার কুতুপালং ডি-ফোর মরকদ মসজিদে ইমামতি করেন মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক। এই মসজিদে প্রায় চার হাজার রোহিঙ্গা ঈদের জানাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে রোহিঙ্গারা যাতে তাদের হারানো অধিকার ও ভিটেবাড়ি ফিরে পেয়ে স্বদেশে ফিরে যেতে পারেন এ কামনা করা হয়। এ সময় অনেকে জোরে জোরে কাঁদতে থাকেন।

কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা মসজিদ ও নুরানী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঈদের জামাত আদায় করেছেন। উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থিত এক হাজার ২০টি মসজিদ ও ৫৪০টি নুরানী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মক্তব) ও টেকনাফের নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৫টি, অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২৪৫টি ও ২০টি নুরানী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (মক্তব) রয়েছে। এসব মসজিদ ও নুরানী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঈদের জামাত আদায় করেছেন ধর্মপ্রাণ মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, ২০১২ থেকে ২০১৮। মাঝে ৬ বছর।এই ছয় বছরে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহাসহ ১২টি ঈদ উৎসব পালিত হয়েছে। কিন্তু উৎসবগুলোতে ঈদের নামাজ আদায় করতে পারেনি মিয়ানমারের রাখাইনের হতভাগা রোহিঙ্গা মুসলমানেরা। ৬ বছর পর জামায়াতের সাথে নামাজ আদায় করতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত রোহিঙ্গারা।এই জন্য তারা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছেন। দীর্ঘ ছয় বছর পর প্রকাশ্যে বড় ঈদ জামায়াতে সালাত আদায় করতে পেরে খুবই আনন্দিত শরণার্থীরা।
রোহিঙ্গারা জানান, ২০১২ সালের জুন মাসে রাখাইনে বৌদ্ধ উগ্রবাদীদের দ্বারা সৃষ্ট দাঙ্গার পর রোহিঙ্গাদের কোণঠাসা করে রাখার মাত্রা বাড়িয়ে দেয় মিয়ানমারের প্রশাসন । একের পর এক মসজিদ ও মাদরাসায় তালা লাগিয়ে দেয়। বেশ কিছু মসজিদ ধ্বংস করে দেয়। ৩ জনের অধিক রোহিঙ্গার একত্রে অবস্থানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে জামায়াতের সাথে নামাজ আদায় না করতে দেয়নি। সে থেকে উত্তর রাখাইনেন বড় ঈদ জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়নি।বাসা-বাড়িতে গোপনে ছোট-খাট জামায়াতের মাধ্যমে জুমা ও ঈদের সালাত আদায় করত রোহিঙ্গারা। এবার নামাজ শেষে মোনাজাতে অঝোর ধারায় কাঁদেন রোহিঙ্গারা।

এসময় তারা শান্তিপূর্ণভাবে স্বদেশে ফিরতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন।বাংলাদেশসহ সহযোগিতাকারী অন্যান্য রাষ্ট্রের উন্নতি ও শান্তির জন্য দোয়া করে তারা। স্বজনহারা অনেক রোহিঙ্গা মা ঈদের দিন সারাদিন পুর্বদিকে তাকিয়ে কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন।এখনো স্বপ্ন দেখেন আরাকানে শান্তি ফিরে আসবে, আর সন্তানসহ আত্মীয়স্বজন নিয়ে রাখাইনে ফিরে যাবেন এমন প্রত্যাশা করছেন অনেকেই।

ঈদে মুষ্টিমেয় রোহিঙ্গারা নিজ উদ্যোগে কিনে নতুন কাপড় পরিধান করেছেন । তবে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা পুরনো কাপড়েই ঈদ করেছেন। রোহিঙ্গা শিশুরাও অন্য সাধারণ দিনের মতো ঈদের প্রথম দিন কাটান।ঈদের দিনে কিছু রোহিঙ্গার বাড়িতে সেমাই রান্না হলেও, বেশিরভাগ ছাউনিতে নিত্যদিনের মতো ভাত, সবজি, শাক ও ডাল রান্না হয়।

স্বল্প পরিসরের যে ঘরে তারা থাকছেন কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ আর জলকাদায় তাও দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। নগদ টাকার অভাবে অনেকেই ছেলে-মেয়েদের জন্য নতুন জামা-কাপড় কিনতে পারেননি বলে আক্ষেপ করেন।
রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, ঈদ উপলক্ষে প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে ঈদ সামগ্রী দেয়া হয়েছে; তবে তা চহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। তবে প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ঈদ উদযাপনে প্রত্যেক রোহিঙ্গা পরিবারের জন্য চাহিদামতো ঈদ সাগ্রমী বিতরণ করা হয়েছে।

কুতুপালং মধুরছড়া ক্যাম্পের বাসিন্দা আব্দুস সাত্তার (৫০) বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে ধরে ঝড়ো হাওয়া ও ভারী বর্ষণের পাশাপাশি ভূমিধসের ফলে বিধ্বস্ত হয়েছে রোহিঙ্গাদের তিন শতাধিক বসতঘর। ঝুপড়ি ঘরগুলোতেও ঢুকে পড়ছে বৃষ্টির পানি। এছাড়া ক্যাম্পের হাঁটাচলার পথও জলকাদায় পরিণত হওয়ায় দুর্ভোগের অন্ত নেই রোহিঙ্গাদের। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যাঁর যাঁর নিজের সামর্থ্য মতো খাবার রান্না করেছেন। কোনো কোনো শিশু ঈদের নতুন জামা পেয়েছে। কেউবা পুরোনো সবচেয়ে ভালো জামাটা পরে ঘুরেছেন।

এই প্রসঙ্গে উখিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ নিকারুজ্জামান বলেন, ‘উখিয়া উপজেলায় এক হাজারের বেশি মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন রোহিঙ্গারা। তাদের মধ্যে আনন্দের ভাব ছিল। শিশুরা একে অপরের সঙ্গে খেলায় মেতেছে। ডি-ফোর ও ডি-ফাইভ এলাকার বিভিন্ন জায়গায় শিশুদের আনন্দ দেয়ার জন্য খোদ রোহিঙ্গারাই নাগরদোলার আয়োজন করেছেন। শিশুরা বেশ আনন্দ নিয়ে সেসব নাগরদোলায় চড়ছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement