২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

একটা নতুন জামার জন্য হাউমাউ কান্না সন্তানের, রোহিঙ্গা বাবা অসহায়

একটা নতুন জামার জন্য হাউমাউ কান্না সন্তানের, রোহিঙ্গা বাবা অসহায় - ছবি : নয়া দিগন্ত

আজ চাঁদ দেখা গেলে কাল ঈদুল ফিতর। এই ঈদুল ফিতর মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর । এবারই প্রথম বাংলাদেশের আশ্রয় কেন্দ্রে ঈদুল ফিতর উৎযাপন করবে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা । কিন্তু ঈদের কোনো আমেজই নেই নিঃস্ব রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে।

গত বছরের ২৫ আগষ্টের পর উখিয়া ও টেকনাফের বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সাত লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে থেকে বসবাসকারী আরো তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গাসহ ১০ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস এখন উখিয়া-টেকনাফে। বৃষ্টির কারণে বিশেষ করে নতুন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের জনজীবনে নেমে এসে বিপর্যয়। রাখাইনে মিয়ানমারের সেনা, বিজিপি ও রাখাইন উগ্রবাদীদের নির্যাতনের শিকার হয়ে এ দেশে পালিয়ে এসে এবার তাদের বেঁচে থাকার লড়াই প্রকৃতির বিরুদ্ধে। এর মধ্যে চলছে আসন্ন ঈদকে ঘিরে মুসলমানদের ঘরে ঘরে চলছে খুশির আমেজ । ঈদের কেনাকাটা, বাহারি খাবারের আয়োজন আর আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে সবখানে। ঈদকে কেন্দ্র করে বাড়তি আনন্দের দুঃসাহস কোনো রোহিঙ্গারই নেই । থাকবেই বা কী করে যেখানে নুন পানি দিয়ে দু’মুঠো-দুবেলা খাওয়ার জোটে না সেখানে ঈদের আনন্দ যেন আমাবশ্যার চাঁদ।

তবে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া পুরনো রোহিঙ্গারা কিছুটা নির্ভার । তাদের জন্য নির্ধারিত ত্রাণে সংসার চলে । ফলে বাহ্যিক আয় করে উৎসবে আনন্দ ভাগাভাগি করার সামার্থ তাদের থাকে। কিন্তু নতুন করে আশ্রয় নেয়া সাত লক্ষাথিক রোহিঙ্গার সে সামর্থ নেই । মাথা গোঁজার ঠাঁই আর খাবার সংগ্রহের চিন্তায় যেখানে ব্যস্ত থাকতে হয়, সেখানে অবুঝ ছেলেমেয়েদের ঈদের জামা কিনে দেয়া আর দৈনন্দিন ডাল-ভাতের রুটিনের বাইরে সেমাই-পায়েশ রান্নার ব্যয় নির্বাহ কল্পনাতীত।

বালুখালি নতুন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সরোয়ার আলম (৪৭) নামের একজন জানিয়েছেন, সন্তানেরা ঈদের জামা কেনার জন্য হাউমাউ করে কান্না করছে। কিন্তু আমি এমন অভাগা পিতা যে, তাদের মুথে একটু হাসি ফুটাতে ব্যর্থ।

কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জাফর আলম (৩৩) জানান, বিভিন্ন সংস্থা থেকে কিছু চাল, ডাল, তেল সহায়তা পেয়েছি । তা নিয়ে সংসার চলে। কিন্তু ঈদের জন্য কোন কিছু কেনার টাকা নেই । মেয়েটার পুরনো জামাটা ভাল করে ধুয়ে ঈদের দিন পরতে দেবো।
মধুরছড়া ১৭নং ক্যাম্পের আশ্রিত রোহিঙ্গা দিল মোহাম্মদ, শফিকুর রহমান জানান, গত ৫দিনের বৃষ্টিতে এখানকার রোহিঙ্গারা ঝুপড়ি থেকে বের হতে পারছে না। পানি বন্ধি অবস্থায় অনাহারে অনাধারে স্ত্রী,পুত্র-পরিবার-পরিজন নিয়ে দিন যাপন করতে হচ্ছে।

উল্লেখ্য, গত কয়ে ক'দিনের ভারী বর্ষণে এখানেদুই শতাধিক কাঁচা ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। মারা গেছে তিন বছরের এক শিশুসহ দুজন। ফলে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে রোহিঙ্গারা।

আরো পড়ুন :

বৃষ্টিতে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জীবন
বিবিসি

টানা বৃষ্টি এবং ছোট-খাটো ভূমিধসের কারণে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এখন বেহাল দশা। পানি এবং কাদামাটিতে একাকার হয়ে গেছে ক্যাম্পের কোন কোন জায়গা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, বিভিন্ন সংস্থার ত্রাণ কর্মীরা হাঁটু পর্যন্ত পানির ভেতর দিয়ে হেঁটে ক্যাম্পে ঢুকছেন এবং তাদের ত্রাণ কাজ পরিচালনা করছেন। অনেক জায়গায় রোহিঙ্গারা হাঁটু সমান উচ্চতার পানিতে দাঁড়িয়ে ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছেন।

বর্ষা মওসুম শুরুর আগেই স্থানীয় প্রশাসন প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গাকে চিহ্নিত করেছিল যারা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করছেন।

সে তালিকার উপর ভিত্তি করে গত ১০ই জুন পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানালেন শরণার্থী ত্রাণ এবং প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার আবুল কালাম। তিনি জানান বাকিদের সেখান থেকে সরিয়ে নেবার কাজ চলছে।

প্রশাসনের হিসেবে ৫০ হাজার মানুষের মধ্যে প্রায় অর্ধেক তীব্র ভূমিধসের ঝুঁকিতে এবং বাকি অর্ধেক বন্যার ঝুঁকিতে ছিল বলে উল্লেখ করেন শরণার্থী বিষয়ক কমিশনার। ভূমিধস এবং অতিবৃষ্টির কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কোন প্রাণহানি হয়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বর্ষা মওসুম শুরুর তিনমাস আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। সারা বছর কক্সবাজার অঞ্চলে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়, গত তিনদিনে সেটির এক তৃতীয়াংশ হয়ে গেছে। এ থেকে বোঝা যায় বৃষ্টিপাতের মাত্রা কতটা প্রবল ছিল।

স্থানীয় সাংবাদিক ওবাইদুল হক চৌধুরী বলেছেন, বৃষ্টি এবং কাদার জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে হাঁটার কোন অবস্থা নেই। তিনি জানিয়েছেন, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাদের কর্মীদের ঈদের ছুটিও বাতিল করেছে। গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গার বাসস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে কর্মকর্তারা বলছেন।

বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্ট-এর জান্নাতুল ফেরদৌস মঙ্গলবার উখিয়া ক্যাম্পের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে দেখেছেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী ক্যাম্পে ঢুকতে মূল সড়কগুলো পানির নিচে তলিয়ে গেছে। রাস্তার দু'পাশে শরণার্থীদের অধিকাংশ ঘরে পানি ঢুকেছে।

যাদের ঘর পাহাড়ের পাদদেশে, ঢালে কিংবা উপরে তাদের সেখান থেকে সরিয়ে ক্যাম্প এলাকার মধ্যে অবস্থিত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানান জান্নাতুল ফেরদৌস।

যাদের ঘরে পানি উঠেছে তারা উঁচু জায়গায় অবস্থিত অন্য শরণার্থীদের ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। "শিশু এবং বয়স্করা সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে," বলছিলেন জান্নাতুল ফেরদৌস।

গত দু'দিন যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে সেটি আরো কয়েকদিন অব্যাহত থাকলে প্রচুর ভূমিধসের আশংকা আছে বলে তিনি মনে করেন।

২০১৬ সালের অক্টোবর মাসের পরে এবং ২০১৭ সালের অগাস্ট মাসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার পর আট লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। নতুন এবং পুরনো - সব মিলিয়ে দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এখন বসবাস করছে কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে।

পুরো জেলায় ৫ হাজার ৮শ একর ভূমি এখন রোহিঙ্গাদের দখলে। কৃষিজমি, পাহাড় বন উজাড় করে নির্মিত এই বসতি বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্যই এখন বিরাট ঝুঁকি তৈরি করেছে।

বর্ষা শুরুর বেশ আগে থেকেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সতর্ক করে দিয়েছে লাখ-লাখ রোহিঙ্গা ভূমিধস, ঝড় এবং বন্যার ঝুঁকিতে আছে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার আবুল কালাম বলেন,পূর্ব প্রস্তুতি থাকার কারণে বড় ধরনের কোন বিপর্যয় ঘটেনি।

উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসরত একজন বাসিন্দা দিল মোহাম্মদ জানালেন, তিনি যেখানে বসবাস করছেন সেখানে পাঁচ শতাংশ বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গারা অন্য রোহিঙ্গাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে বলে তিনি জানান।

দিল মোহাম্মদের ভাষ্য অনুযায়ী, ভূমিধস নিয়ে নানা আশংকা এবং প্রচারণা থাকার কারণে রোহিঙ্গাদের অনেকেই বৃষ্টি শুরুর সাথে সাথে সতর্ক হয়ে গেছে। তবে এখনো অনেকে ঝুঁকি-পূর্ণভাবে বসবাস করছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।


আরো সংবাদ



premium cement