২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
উজিরপুরে চেয়ারম্যান নান্টু হত্যা

আদালতে আসামীদের জবানবন্দিতে জন্ম নিয়েছে নয়া রহস্য

নিহত চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ হালদার নান্টু
নিহত চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ হালদার নান্টু - ছবি : সংগৃহীত

বরিশালের উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ হালদার নান্টু হত্যায় এবার প্রকাশ্যে এসেছে চাঞ্চল্যকর এক তথ্য। হত্যাকান্ডের প্রায় সাড়ে চার মাস পর জানা গেছে নিহত চেয়ারম্যান নান্টুর সাথে উপজেলা চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান ইকবালের ভিতরগত বিরোধ ছিলো।

তাদের মধ্যে কোটি টাকা মূল্যের দুটি কষ্টি পাথরের মূর্তি নিয়ে গোপন বিরোধ চলে আসছিলো। সেই বিরোধকে কেন্দ্র করে চেয়ারম্যান নান্টুকে খুন করা হতে পারে এমন জবানবন্দি দিয়েছেন হত্যা মামলায় এজাহারভুক্ত জেল হাজতে থাকা দুই আসামী।

তারা হলেন- জল্লা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি মামুন শাহ ও ছাত্রলীগ নেতা কাওসার সেরনিয়াবাত। এই দুই আসামী গ্রেফতার হওয়ার পরে আদালতে যে জবানবন্দি দিয়েছিলো তা প্রত্যাহার চেয়ে নতুন করে জবানবন্দি দিয়েছে। আর সেই জবানবন্দিতে নান্টু হত্যার তদন্তে আসতে পারে নতুন মোড়। তারা প্রথম জবানবন্দি পুলিশের নির্মম শারিরিক নির্যাতন ও উপজেলা চেয়ারম্যান ইকবালের প্ররোচনায় দিয়েছিলেন। এমন দাবী করে গত ৩ ফেব্রুয়ারি তা প্রত্যাহারের আবেদন এবং একই সথে নতুন জবানবন্দি দিয়েছেন এজাহারভূক্ত আসামী মামুন শাহ ও কাওসার সেরনিয়াবাদ।

মামলার নথি পর্যালোচনা দেখা গেছে, চেয়ারম্যান নান্টু হত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় জেল হাজতে থাকা এজাহারভুক্ত ৬ আসামী গত বছরের ৮ নভেম্বর একই আদালতে তাদের দেওয়া ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহারের জন্য পথক পৃথকভাবে লিখিত আবেদন করেন। আদালতের বিচারক মোঃ এনায়েত উল্লাহ্ আসামীদের দেওয়া আবেদনপত্রগুলো আমলে নিয়ে শুনানির তারিখ ধার্য রাখেন।

আদালতে যারা আবেদন করেছেন তারা হলেন- জেল হাজতে থাকা মামলার এজাহার ভুক্ত আসামী শাকিল ইসলাম রাব্বি, কাওসার সেরনিয়াবাত, আ: কুদ্দুস, দীপক বালা, মামুন শাহ্ ও হাদিরুল ইসলাম হাদি। এরা সকলেই আবেদনপত্রে আদালতে নিজেদের দেওয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দি অনিচ্ছাকৃত দাবী করে পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন।
তারা পুলিশের বিরুদ্ধে তাদের (ছয় আসামী) প্রায় চারদিন আটকে রেখে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছে বলে বিচারককে লিখিত অভিযোগ করেন। তাছাড়া পুলিশ তাদের প্রত্যেককে ক্রসফায়ার ও পরিবারের সদস্যদের আটকে নির্যাতনের ভয়-ভীতি দেখিয়ে আদালতে হত্যার দায় স্বীকারমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে বলেও অভিযোগ করে।
এদের মধ্যে লিখিত জবানবন্দীতে এজাহারভূক্ত আসামী কাওসার সেরনিয়াবাদ বিচারককে জানিয়েছেন, উপজেলার জল্লা এলাকার বরিয়ালির বাসিন্দা সান্টু ও উপজেলা চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান ইকবালের সাথে খুন হওয়া চেয়ারম্যান নান্টুর ২টি কষ্ঠি পাথরের মূর্তি নিয়ে বরারবরই বিরোধ চলে আসছিল। পরে এ বিষয়ে সান্টুর কাছে জানতে চাইলে সান্টু তাকে জানায় মূর্তি দুইটি ইকবাল ভাইয়ের কাছে আছে। কিন্তু নান্টু দাদার কাছ থেকে ইকবাল ভাই মূর্তি নিয়ে এখন অস্বীকার করছে।

আসামী মামুন শাহ তার জাবনবন্দিতে বলেন, নান্টু খুন হওয়ার কিছুদিন পূর্বে বরিয়ালি গ্রামের বাসিন্দা সান্টু ও উপজেলা চেয়ারম্যান ইকবালের সাথে নিহত চেয়ারম্যান নান্টুর বিরোধ চলে আসছিল। নান্টুর সহযোগী ও কুলের বাজারের বাসিন্দা লাবাই বাড়ৈ’র মাধ্যমে কষ্টি পাথরের মূর্তি ইকবালকে দেয়া হয়েছে। ইকবাল সেই মূর্তি আত্মসাৎ করে মূর্তি নেয়ার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দীঘদিন ধরে গোপন বিরোধ চলে আসছিল।

আসামী দীপক বালা তার লিখিত জবানবন্দীতে বলেন, চেয়ারম্যান নান্টু হত্যার ঘটনায় তিনি কিছুই জানেনা। কিন্তু নান্টু মাদক ব্যবসায় জড়িত এ সংক্রান্ত তিনি নিজের একটি ভিডিও বক্তব্য ইউটিউবে প্রকাশ করেন। এ কারণে পুলিশ তাকে প্রেফতার বরিশাল জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে উজিরপুর মডেল থানার ওসি শিশির কুমার পালের উপস্থিতিতে উপজেলা চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান ইকবাল তার সাথে সাক্ষাত করে তাকে (দিপক) মামলা থেকে রেহাই দেওয়ার প্রলোভন দেখায়।

এ সময় চেয়ারম্যান ইকবাল তাকে রাব্বি, টিটু, শেখর চৌধুরী, কাওসার সেরনিয়াবাত, মিরাজ সেরনিয়াবাত, হাদি, মামুন শাহ্ এই নাম গুলো মুখস্ত করিয়ে বলে নান্টুর হত্যার বিষয়ে কেউ জিজ্ঞেস করলে এই নামগুলো বলবি। স্বাক্ষর চাইলে স্বাক্ষর করবি। তোর কোন ভয় নাই। তোর জন্য যা কিছু করা দরকার আমি করবো। এ কথা বলে ইকবাল দীপক বালাকে নগদ ৩ হাজার টাকা এবং একটি লুঙ্গি ও গেঞ্জী কিনে দিয়ে যায়।

আসামি সাকিল ইসলাম রাব্বি আবেদনে উল্লেখ করেছেন, হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উজিরপুর মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (ওসি তদন্ত) হেলাল উদ্দিনসহ একদল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গত বছরের ৪ নভেম্বর ঢাকায় তার ছাত্রলীগের কার্যালয় থেকে তাকেসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করে। এ সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনির সদস্যরা সেখানেই তাদের সকলের হাতে পিস্তল, ইয়াবা ও সাদা লবন জাতীয় প্যাকেট দিয়ে ভিডিও করে।

এমনকি তার (রাব্বি) অফিসের সিসি ক্যামেরা, মনিটর, প্রাইভেটকারের চাবি, নিজের চিকিৎসার কাগজপত্র, নগদ অর্থ, ট্যাব ও মোবাইলসহ বিভিন্ন ধরনের জিনিস নিয়ে যায় পুলিশ। যা সেখানকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করলে তা দেখা যাবে। পরে পুলিশ তাকে নিয়ে যায় রাজধানীর মিন্টু রোডের ডিবি অফিসে। সেখানে পুলিশ তার হাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে ও চোখ মুখ বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন চালায় এবং হাতিরঝিলে নিয়ে ক্রসফায়ারের হুমকি দেয়।

আসামী শাকিল ইসলাম রাব্বি আবেদনে আরও উল্লেখ করে, তাকে বরিশাল জেলা ডিবি অফিসে নিয়ে একটি রুমে আটকে তাকে নগ্ন করে ইলেকট্রিক শর্টসহ নির্মম শারিরিক নির্যাতন চালায়।

এ সময় উজিরপুর মডেল থানার ওসি শিশির কুমার পাল তাকে (রাব্বি) বলে, নান্টু ইয়াবা ব্যবসা করে সে দৃশ্য কেন ইন্টারনেটে ছেড়ে দিলি, নান্টু ভিজিএফএর চাল চুরি করেছে এ নিয়ে কেন মানববন্ধন করেছিস। এটাই তোর অপরাধ। এখন আমরা যেভাবে বলবো সেভাবেই স্বীকারোক্তি দিবি। অন্যথায় রিমান্ডে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারের অভিযানের নামে নান্টু যেখানে মারা গেছে সেখানেই তোকে ক্রসফায়ার দেবো। আর তোর পরিবারের সবাইকেও গ্রেফতার করে তোর মতো অবস্থা করবো।
এদিকে আদালতে আসামীদের দাখিলকৃত আবেদনপত্র গুলোর মাধ্যমে চেয়ারম্যান নান্টু হত্যাকান্ডের ঘটনা তদন্তে নতুন করে মোড় নিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বেরিয়ে আসতে পারে হত্যার পিছনের অন্য কোনো রহস্য। ফেঁসে যেতে পারে উপজেলা চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান ইকবাল।

যিনি জল্লার জননন্দিত চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বিশ্বজিৎ হালদার নান্টু হত্যার এক ঘন্টার মধ্যেই গণমাধ্যমকর্মীদের ক্যামেরার সামনে বলেছিলেন হত্যায় কে বা কারা জড়িত। তবে এতো অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কিভাবে নিশ্চিত হয়েছিলেন যে চেয়ারম্যান নান্টুকে কারা হত্যা করেছিলো আর তিনিই বা কিভাবে জানলেন এমন প্রশ্নের উত্তর আজও সবার কাছে রয়েছে অজানা। এ নিয়ে উজিরপুরের একাধিক গন্যমান্য ও রাজনৈতিক নেতা মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

এ ঘটনায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উজিরপুর মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (ওসি তদন্ত) মো: হেলাল উদ্দিন বলেন, মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম চলমান। ফরেনসিক ও ব্যালেস্টিক রিপোর্ট হাতে পেলে চার্জশীট প্রদান করা হবে। আসামীদের নির্যাতনের, মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।

উল্লেখ্য, গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে ৯টায় উপজেলার জল্লা ইউনিয়নের কারফা বাজারে নিজ কাপড়ের দোকানে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন ইউপি চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ হালদার নান্টু। এ ঘটনায় পরেরদিন ২২ সেপ্টেম্বর রাতে নিহত ইউপি চেয়ারম্যান নান্টুর বাবা শুখলাল হালদার বাদি হয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির ৩২ জনের নাম উল্লেখ ও ৮ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে উজিরপুর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলার এজাহারভুক্ত কমপক্ষে ২০ আসামী বর্তমানে বরিশাল জেল হাজতে রয়েছে।

এছাড়া এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় গত বছরের ১৩ নভেম্বর রাতে মাদারীপুর জেলার কালকিনী উপজেলার বাসিন্দা রবিউল ইসলাম নামে এক যুবক পুলিশের সাথে বন্ধুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে এবং পুলিশের দাবী ছিলো নিহত যুবক ইউপি চেয়ারম্যান নান্টুকে গুলি করে হত্যাকারী।


আরো সংবাদ



premium cement
কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পান, সেভাবেই ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে : কৃষিমন্ত্রী চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে সিএনজি ও বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২, আহত ৪ ভান্ডারিয়ায় ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা দেখতে দর্শনার্থীদের ঢল তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ৭ দিন স্কুল বন্ধের দাবি চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত বিএনপি সাম্প্রদায়িক শক্তি, এদের রুখতে হবে : ওবায়দুল কাদের সাদিক এগ্রোর ব্রাহামা জাতের গরু দেখলেন প্রধানমন্ত্রী ভারতে লোকসভা নির্বাচনে প্রথম ধাপে ভোট পড়েছে ৬০ শতাংশ সারা বিশ্ব আজ জুলুমবাজদের নির্যাতনের শিকার : ডা. শফিকুর রহমান মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশী : পররাষ্ট্রমন্ত্রী চন্দনাইশ, বাঁশখালী ও বোয়ালখালীতে ৩ জনের মৃত্যু

সকল