২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বরিশালে আলো ছড়াচ্ছে ‘আমাদের পাঠশালা’

বরিশালে আলো ছড়াচ্ছে ‘আমাদের পাঠশালা’ - ছবি : নয়া দিগন্ত

বরিশাল নগরীর পাশ দিয়ে অবিরাম বয়ে চলা কীর্তনখোলা নদীর তীরে গড়ে উঠেছে মুক্তিযোদ্ধা পার্ক। এই পার্কের সবুজ-শ্যামল গাছের ছায়া আর মুক্ত বাতাসে প্রতিদিন ঘুরতে আসেন বহু মানুষ। তবে প্রতি শুক্রবার সকালে এখানে ঘুরতে আসা মানুষের চোখ আটকে যায় পার্কের ডান প্রান্তের ছোট্ট করিডোরে। যেখানে দেখা যায় পার্কের মধ্যে পুরনো ব্যানার, পলিথিন কিংবা চট বিছিয়ে ছোট ছোট পথশিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়ানোর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে একদল তরুণ-তরুণী। নিজেদের মানবিক দায়বোধ থেকে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বিনামূল্যে প্রায় তিন বছর যাবৎ এই কাজ করছে স্ট্রিট চিলড্রেন নউস ডেভেলপমেন্ট ক্লাব, যা এসএনডিসি নামে সমধিক পরিচিত। এসএনডিসির অনেক সামাজিক কাজের মধ্যে ‘আমাদের পাঠশালা’ এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল আলোচিত। বরিশালের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একঝাঁক তরুণ-তরুণীর স্বেচ্ছাশ্রমে পরিচালিত অসহায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সুন্দর আগামী গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করছে এসএনডিসি। 

এসএনডিসির সভাপতি তানজীল ইসলাম শুভ ও সেক্রেটারি হাসিব মৃধা জানান, আমাদের বেশির ভাগ তরুণ সমাজ যেখানে সারাদিন মোবাইল, ফেসবুক, গেমসহ নানা ধরনের আড্ডায় মশগুল, ঠিক সেই সময়ে আমরা নীরবে-নিভৃতে সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও নিরক্ষর মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। নিজেদের মানবিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এসএনডিসির সদস্যরা সম্মিলিতভাবে মহৎ এই কাজ করে যাচ্ছেন। 

গতকাল ৫ অক্টোবর শুক্রবার বরিশাল নগরীর মুক্তিযোদ্ধা পার্ক ঘুরে দেখা যায়, প্রায় অর্ধশত পথশিশুকে পাঠদান করাচ্ছেন এসএনডিসির সদস্যরা। শিশুরাও মনের আনন্দে গ্রহণ করছে জ্ঞানের আলো। অনুভব করা গেল ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে এখানকার প্রতিটি শিশু, যেন কোনো জড়তাই নেই তাদের মনে। 

নগরীর ভাটারখাল বস্তির শিশু জিদিন ও এলমা। তারা আপন ভাইবোন। ওদের সাথে কথা বলে জানা গেল, প্রতি শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত এই পার্কে পড়তে আসে তারা। তাদের বাবা শ্রমিক হিসেবে রকেট ঘাটে কাজ করেন, সরকারি কোনো স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি তাদের। এসএনডিসির সদস্যরা তাদের বাসায় গিয়ে বিনা খরচে পাঠদানের আহ্বান জানালে সাড়া দেন জিদিন ও এলমার বাবা-মা। সেই থেকে গত কয়েক মাস যাবৎ ‘আমাদের পাঠশালা’য় পড়তে আসে তারা। এই প্রতিবেদককে তারা জানায়, ‘এখানে পড়তে আমাদের খুবই ভালো লাগে। এখানকার স্যার ও ম্যাডামরা আমাদের খুবই আদর করেন।’ 

ভাটার খাল বস্তির ছয় বছরের শিশু রিমি আক্তার জানায়, এখানে লেখাপড়া করে সে বাংলা অক্ষর- স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, ইংরেজি অক্ষর ও গণিতের এক থেকে এক শ’ পর্যন্ত সংখ্যা গুনতে শিখেছে। এখানকার স্যার ও ম্যাডামরা তাদের নিয়মিত পাঠদানের পাশাপাশি ছড়া ও গান শেখান বলে কোনো ক্লাসই মিস করে না রিমি। শুক্রবার এলেই রিমির মতো লঞ্চঘাটের অনেক পথশিশুই পড়তে আসে তাদের সবার প্রিয় ‘আমাদের পাঠশালা’য়। 

বিএম কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী ও এসএনডিসির সদস্য ওয়াসিকা আফরিন বিনু জানান, আমাদের বর্তমান সমাজের বেশির ভাগ কাজই যখন স্বার্থসংশ্লিষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তখন আমরা বরিশালের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নিঃস্বার্থভাবে জ্ঞান বিলানোর কিংবা আলো ছড়ানোর এই কাজটি করে যাচ্ছি। 

জয়ন্ত সমাদ্দার, নুসরাত জাহান ইভা, সুইটি, নাইমা, রিমি, শারমিন বিথি, জুনায়েদসহ এসএনডিসির আরো বেশ কয়েকজন সদস্য জানান, আমরা সবাই নিজেদের সাধ্যমতো চাঁদা দিয়ে এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি পরিচালনা করছি এবং নিজেরা স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়ে যাচ্ছি। সমাজের বিত্তবান ও সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমাদের এই সামাজিক কার্যক্রম আরো গতিশীল হবে। 


তরুণ শিক্ষার্থীদের এই মহতি উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন স্থানীয়রা। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এসএনডিসির অন্যতম শাখা ‘আমাদের পাঠশালা’র কার্যক্রম শুরু হয় চলতি বছরের ৫ এপ্রিল। এখন পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানে তিন শতাধিক সুবিধাবঞ্চিত আর নিরক্ষর মানুষ শিক্ষা নিয়েছে এবং নিচ্ছে। এ ছাড়াও এসএনডিসির আরো দুইটি শাখা রয়েছে। তা হলো এসএনডিসি ফুড ব্যাংক ও ব্ল্যাড ব্যাংক। এই শাখাগুলোর মাধ্যমেও তারা সমাজের নিম্নশ্রেণীর লোকদের মাঝে স্বাস্থ্যসেবার কাজ করে যাচ্ছে।

এ ছাড়াও তারা প্রতিটি ঈদ, কোরবানি ও জাতীয় দিবসগুলোতে পথশিশুদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। ঈদে পথশিশুদের নতুন জামা প্রদান, রমজানে ইফতার পার্টি, শীতে কম্বল বিতরণসহ আরো নানা রকম সামাজিক কাজ করে আসছে সংগঠনটি।


আরো সংবাদ



premium cement