২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কুয়াকাটা সৈকতের বালু ক্ষয় : ছোট হচ্ছে মানচিত্র, বিলীন হচ্ছে প্রকৃতি

-

অব্যাহত বালু ক্ষয়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে সাগরকন্যা কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকত। ফলে ছোট হয়ে আসছে কুয়াকাটার মানচিত্র এবং বিলীন হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যাবলী।

প্রতিবছর এ মৌসুমে পূর্ণিমা ও অমাবশ্যার জোয়ারে সমুদ্রের প্রচণ্ড ঢেউয়ের তান্ডবে অব্যাহত বালু ক্ষয়ে দীর্ঘ প্রায় ৩৩ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত লন্ডবন্ড হয়ে গেছে। গত ১০-১২ বছরের ব্যবধানে লতাচাপলী ও কুয়াকাটা মৌজার অন্তত ১০ হাজার একর ভূমি সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ঝুঁকিতে রয়েছে সৈকতের সবুজ বেষ্টনীর দেয়াল, সদ্য জেলা প্রশাসক কর্তৃক নির্মাণাধীন সি বীচ ট্যুরিস্ট পার্কসহ মসজিদ-মন্দির।

ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে জাতীয় উদ্যান (ইকোপার্ক), এলজিইডি’র বায়োগ্যাস প্লান্ট ও বনবিভাগের কয়েক হাজার হেক্টর বনভূমি।

অপরদিকে সৈকতের কোল ঘেঁষে অবস্থিত ছিল প্রকৃতিপ্রেমী ফয়েজ মিয়ার নারিকেল বাগান। ফয়েজ মিয়ার এ নারিকেল বাগানটির প্রতি ছিলো ভ্রমণপিপাসুদের ব্যতিক্রমধর্মী আকর্ষণ। কুয়াকাটা ফার্মস অ্যান্ড ফার্মস নামে বাগানটির নামকরণ থাকলেও সারি সারি নারিকেল গাছ থাকায় নারিকেল বাগান হিসেবেই সকলের কাছে পরিচিত ছিল এটি। দেশের বেসরকারি উদ্যোগে দ্বিতীয় বৃহত্তম এ বাগানটির গা ঘেঁষে সুশীতল দক্ষিণা বাতাস পর্যটকদের মনে এক সময় দোলা এনে দিয়েছে। গাড়ি পার্কিং, পিকনিক স্পট, পর্যটকদের বিনোদন কেন্দ্রের জন্য অন্যতম ছিল এ বাগানটি। কিন্তু কালের বিবর্তনে বাগানটি আজ শুধুই স্মৃতি। প্রকৃতিপ্রেমী ফয়েজ মিয়ার শখের বাগানটির প্রতি মানুষের লোলুপ দৃষ্টি ও সমুদ্রের করাল গ্রাস বিলীন করে দেয় বাগানটি। গতবছর বর্ষার শেষ মৌসুমে বেশ কিছু নারিকেল গাছ মূলের মাটি হারিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। চলতি মৌসুমে তা আর টিকে থাকতে পারেনি। কালের সাক্ষ্য বহনকারী এ গাছগুলো এখন শুধু স্মৃতির পাতার ইতিহাস হয়ে আছে।

আজ থেকে ১০-১২ বছর আগেও কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের জিরো পয়েন্টের পশ্চিম পাশে ছিলো একটি শালবাগান। পূর্ব পাশের প্রায় ২শ’ একর জমিতে ছিলো নারিকেল বাগান। কুয়াকাটায় আগত পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করত বাগান দু’টি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে ঢেউয়ের কারণে বালুক্ষয়ে ধীরে ধীরে সাগরগর্ভে বিলিন হতে থাকে বাগানের এক একটি অংশ। গত বছরের বর্ষা মৌসুমে ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করে বাগানের একটি ক্ষুদ্র অংশ অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু এ বছরের শুরুতেই রাক্ষুসে ঢেউয়ের করাল থাবায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে ফয়েজ মিয়ার সেই শখের নারিকেল বাগান।

সরেজমিনে জানা গেছে, গত ২০ বছর যাবৎ অব্যাহত বালুক্ষয় হচ্ছে। অথচ বালুক্ষয় রোধের চেষ্টা করেনি কোন সরকার। শুধু অস্থায়ীভাবে ঝুঁকিপূর্ণ কিছু জায়গায় ব্লক দিলেও তা এখন সমুদ্রগর্ভে চলে যাচ্ছে। যেকারণে ধীরে ধীরে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হতে থাকে সৈকত লাগোয়া বাগান ও বনভিাগের সৃজিত বনাঞ্চল। কিন্তু বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জোয়ারের পানি অস্বভাবিক বৃদ্ধির পায়। ফলে প্রচন্ড ঢেউয়ের ঝাপটায় বালুক্ষয়ে ছোট হচ্ছে সাগরকন্যা কুয়াকাটার মানচিত্র। রাতারাতি পাল্টে যাচ্ছে তীরঘেষা সংরক্ষিত বনাঞ্চলের চিত্র। অব্যাহত বালুক্ষয়ে মুছে গেছে ফয়েজ মিয়ার বাগানের নাম নিশানাসহ অনেক ভূখন্ড। আতংকে রয়েছে বিনিয়োগকারী ও স্থানীয়রা।

আর এভাবে অব্যাহত বালু ক্ষয় রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকরী ব্যবস্থা না নিলে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের অপরূপ রূপ দেখার স্থান সাগরকন্যা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত একেবারে ¤œান হয়ে যাবে। পর্যটনশিল্প তথা কুয়াকাটাসহ এ অঞ্চলের মাটি ও মানুষের উন্নয়নে রেক্ষাবাঁধ প্রকল্পের কাজ শুরু করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করছে এলাকাবাসী।

কুয়াকাটার বালু ক্ষয়ের ব্যাপারে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) কুয়াকাটা-লতাচাপলী চেয়ারম্যান শফিকুল আলম বলেন, ‘আমি কোনো প্রকৌশলী নই, তবে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে চাই, বালু ক্ষয় রোধ করতে হলে অবশ্যই সৈকতের জোয়ার-ভাটার পানির গতি পরিবর্তনের জন্য একটি গ্রোয়েন বাঁধ নির্মাণ করতে কবে। তাহলেই বালু ক্ষয় রোধ করা সম্ভব হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এ ছাড়া গ্রোয়েনবাঁধটি পর্যটকদের জন্য আলাদা একটি জোন করে দিলে সেখান থেকে সরকার প্রতিবছর লাখ লাখ টাকার রাজস্বও আদায় করতে পারবে।’

পটুয়াখালী সওজ’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো: নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘আমি যদিও ওয়াটার বোর্ডের কোনো প্রকৌশলী নই তবুও বলতে হয় অবিলম্বে বালু ক্ষয় রোধে সৈকতে পাথর ফেলানো অথবা কার্যকরী কোন পদক্ষেপ না নিলে এ বছরই কুয়াকাটা রক্ষার বেড়ীবাঁধটি সৈকতে বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আবুল খায়ের বলেন, আমরা সৈকত রক্ষাবাঁধ প্রকল্পের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রস্তাব পাঠিয়ে ছিলাম কিন্তু প্লানিং কমিশন তা বাতিল করে দিয়েছে- এখন কবে কি হয় তা জানি না।


আরো সংবাদ



premium cement