২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শুকনো মৌসুমেও মেঘনায় ভাঙন বিলীন হচ্ছে কমলনগরের ৫ গ্রাম

মেঘনার ভাঙনে এভাবে বিলীন হচ্ছে কমলনগরের বিস্তীর্ণ এলাকা ও স্থাপনা : নয়া দিগন্ত -

শুকনো মৌসুমেও মেঘনার তীব্র ভাঙনে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার পাঁচটি গ্রাম নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মেঘনা ইতোমধ্যে গিলে খেয়েছে ওই সব গ্রামের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা। ভাঙনকবলিত গ্রামগুলো হচ্ছেÑ চরকালকিনি ইউনিয়নের নাছিরগঞ্জ ও হাজীগঞ্জ, সাহেবেরহাট ইউনিয়নের কাদিরপণ্ডিতের হাট, চরফলকন ইউনিয়নের লুধুয়া ফলকন এবং পাটারীরহাট ইউনিয়নের দক্ষিণ চরফলকন। এতে করে ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটছে ওই সব গ্রামের বাসিন্দাদের।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, শুকনো মৌসুমেও মেঘনা তীরবর্তী গ্রামগুলো ভাঙছে। ভাঙনে বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি, বাড়িঘর, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭০ সালের দিকে চরকালকিনি ও চরফলকন ইউনিয়ন দু’টিতে মেঘনার ভাঙন শুরু হয়। দীর্ঘ পাঁচ দশকের অব্যাহত ভাঙনে চরকালকিনি ইউনিয়নের চরকাঁকড়া, চরসামছুদ্দিন ও তালতলি, সাহেবেরহাট ইউনিয়নের চরজগদ্বন্ধু ও মাতাব্বরনগর, চরফলকন ইউনিয়নের চরকটোরিয়া, চরকৃষ্ণপুর, মাতাব্বরচর ও পাতারচর এবং পাটারীরহাট ইউনিয়নের উরিরচর, পশ্চিম চরফলকন ও ডিএস ফলকন গ্রাম সম্পূর্ণ মেঘনায় বিলীন হয়ে গেছে। ওই সব গ্রামের প্রায় অর্ধ লাখ মানুষ সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই পার্শ্ববর্তী জেলা নোয়াখালীর সদর ও সুবর্ণচর এবং লক্ষ্মীপুরের সদর ও কমলনগর উপজেলার চরকাদিরাসহ বিভিন্ন এলাকায় বাড়িঘর নির্মাণ করে কোনোরকমে বসবাস করছে। বাকিরা আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধে। যাদের বেশির ভাগ এখন দিন কাটে অর্ধাহারে-অনাহারে।
জানা গেছে, গত ৪৯ বছরের ভাঙনে বিলীন হয়েছে এসব এলাকার প্রায় ১৫ হাজার একর ফসলি জমি, সরকারি-বেসরকারি ১৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, আশ্রয়ন কেন্দ্রের পাঁচটি কলোনি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ এবং কয়েক কিলোমিটার কাঁচাপাকা সড়ক, অসংখ্য মসজিদ, বিভিন্ন স্থাপনা ও হাটবাজার।
এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, মেঘনার ভাঙনরোধে স্থানীয়ভাবে একাধিকবার উদ্যোগ নেয়া হলেও তা যেমন সফল হয়নি তেমনি সরকারিভাবে নেয়া উদ্যোগও দেখেনি সফলতার মুখ। ২০০৯ সালে ‘মেঘনার ভাঙন থেকে রামগতি ও কমলনগরকে রক্ষায় নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদিত হয়। প্রকল্পটির আওতায় ২০১৪ সালে একনেক ১৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। প্রথম পর্যায়ের ওই অর্থ দিয়ে কমলনগর উপজেলার মাতাব্বরহাট এলাকায় এক কিলোমিটার ও রামগতি উপজেলায় সাড়ে চার কিলোমিটার এলাকায় ব্লকবাঁধ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু কমলনগর উপজেলার অন্য ১২ কিলোমিটার এলাকা অরক্ষিত থেকে যায়। ভাঙনের তাণ্ডব চলতে থাকায় গেল বর্ষা মৌসুমে লুধুয়া ফলকন এলাকায় আপদকালীন কাজের অংশ হিসেবে প্রায় আট কোটি টাকা ব্যয়ে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হয়। কিন্তু ভাঙনের তীব্রতায় তাও নদীতে বিলীন হওয়ার পথে। এখন তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থ ছাড় না হওয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন প্রতিরোধে যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারছে না। যে কারণে এলাকাবাসী একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা প্রকল্পটি অনুমোদন ও অর্থ ছাড় করাসহ দ্রুত টেকসই বাঁধ নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানান।
স্থানীয়দের অভিমত, বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগে মেঘনার ভাঙনরোধে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু না হলে এবং ভাঙন অব্যাহত থাকলে আগামী দুই বছরের মধ্যে কমলনগর উপজেলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বিলীন হয়ে যেতে পারে।
মেঘনার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার লুধুয়া ফলকন এলাকার মাস্টার আবদুল মন্নান জানান, কয়েক বছর ধরে ভাঙনের মুখে পড়ে তাদের কয়েক একর জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এখন বসতবাড়িটিও হুমকির মুখে। ভাঙন প্রতিরোধের প্রকল্পটি অনুমোদন ও কাজ শুরু হলে তার বসতবাড়িটি ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পেত। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমরা অন্য কিছু চাই না, শুধু নদীভাঙন থেকে রক্ষা পেতে চাই।’
পাটারীরহাট ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ছালেম মৃধা জানান, শুকনো মৌসুমেও তাদের এলাকায় মেঘনায় ভাঙন চলছে। গত কয়েক সপ্তাহের ভাঙনে তার বসতবাড়ির বেশির ভাগ অংশ বিলীন হয়ে গেছে।
জেলা পরিষদের সদস্য মোশারেফ হোসেন বাঘা জানান, গত সেপ্টেম্বর মাসে লুধুয়া ফলকন এলাকার চরফলকন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দু’টি দোতলা ভবন, একটি মসজিদ ও একটি কমিউনিটি ক্লিনিক ভবন রক্ষায় তারা ব্যক্তিগত অর্থায়নে প্রথমে জংলা বাঁধ দেন। পরে স্থানীয় সংসদ সদস্যের প্রচেষ্টায় সেখানে জিও ব্যাগ ডাম্পিংয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু ভাঙনের তীব্রতার কারণে সেই ভবনগুলোও রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
সাহেবেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল খায়ের জানান, মেঘনার ভাঙনে তার ইউনিয়নের চারটি গ্রামসহ আট বর্গকিলোমিটার এলাকা বিলীন হয়ে গেছে। এতে বসতভিটাসহ সর্বস্ব হারিয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। ভাঙন অব্যাহত থাকায় এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
পাটারীরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এ কে এম নুরুল আমিন রাজু জানান, ২০১৪ সালে ভাঙন প্রতিরোধের প্রকল্পটি অনুমোদনের পর তার ইউনিয়নের বাসিন্দারা বাপ-দাদার ভিটেমাটিতে নতুনভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু সাহেবেরহাট এলাকায় মাত্র এক কিলোমিটার বাঁধ হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থ ছাড় না হওয়ায় তারা এখন হতাশ হয়ে পড়েছেন। তিনি জানান, গেল বর্ষা মৌসুমে মেঘনার ভাঙনে তার ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ জনপদ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এতে করে বসতবাড়ি ও ফসলি জমি হারিয়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়েছে। আগামী বর্ষা মৌসুমের আগে ভাঙনরোধে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া না হলে তার ইউনিয়নের অনেক এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক আহমেদ জানান, মেঘনার ভাঙনরোধে কমলনগর ও রামগতি উপজেলার তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজের নতুন ডিপিপি প্রস্তুত করা হয়েছে। বর্তমানে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে থাকা নতুন প্রস্তাবনাটি অনুমোদন হলে ভাঙনরোধে টেকসই বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হবে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য মেজর (অব:) আবদুল মান্নান জানান, দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে মেঘনার ভাঙনে কমলনগর উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছে। ভাঙন প্রতিরোধে ব্যক্তিগত অর্থে বাঁধ নির্মাণ ছাড়াও তিনি বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ভাঙনের তীব্রতার কারণে তার উদ্যোগ সফল হয়নি। তিনি বলেন, ভাঙনরোধে নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ অনুমোদনের চেষ্টা চলছে। আশা করছেন প্রকল্পটি অল্প সময়ের মধ্যেই একনেকে অনুমোদন হবে। আর এতে এ উপজেলাবাসীর দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement