১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চুয়াডাঙ্গায় অপরিকল্পিত নগরায়ন হারিয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ

একটি ফাঁকা মাঠে বিল্ডিং নির্মাণ করা হচ্ছে পাশে শিশুকিশোররা ঘুড়ি উড়াচ্ছে : নয়া দিগন্ত -

আধুনিকতাও প্রযুক্তির ছোঁয়া, ঐতিহ্য বিমুখতা, গ্রামমুখী না হওয়া, শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হওয়া, কর্মমুখী ব্যস্ত জীবনসহ নানা কারণে বাংলার পুরনো ঐতিহ্য-সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার পথে। বলা যায়, অনেক কিছু এখন হারিয়ে গেছে। হারানোর এমন তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের অনেকেই গ্রামীণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনেক কিছুই চেনে না, জানে না অনেক গ্রামীণ খেলাধুলা নামও।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে প্রতিযোগিতা করে বাড়ছে ভবন। ভবন বাড়ার সাথে সাথে কমছে খোলা স্থান, আঙিনা, মাঠ ও পরিত্যক্ত ভূমি। এটি অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলই বলা যায়। তাই এখন শঙ্কা দেখা দিয়েছে, আগামী দশক পর নগরে আর কোনো খেলার মাঠ অবশিষ্ট থাকবে কি না। এ ছাড়া খেলার মাঠগুলো বাণিজ্যিক মেলার ফাঁদে পড়ার কারণে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে কোমলমতি শিশুদের মনন বিকাশের স্থান। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশু-কিশোরদের প্রারম্ভিক বয়সের উৎকর্ষ বিকাশ। অথচ শিশু-কিশোরদের জন্য প্রয়োজন মুক্ত আঙিনা। কারণ শিশুরা নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যেই যথাযথ বিকাশ না হলে ভবিষ্যতে এর নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা বেশি।
চুয়াডাঙ্গায় কয়টি খেলার মাঠ ছিল, এ নিয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও শহরে একসময় ছিল খেলার মতো পর্যাপ্ত মাঠ। তা ছাড়া সে সময় শহরের জনসংখ্যাও কম থাকায় বাড়ির পাশে ছিল পর্যাপ্ত খোলা জায়গা। এসব খোলা জায়গায় দল বেঁধে শিশু-কিশোররা খেলত ইচিং-বিচিং, ওপেন টু বাইস্কোপ, কড়ি খেলা, কানামাছি, লাঠি খেলা, কাবাডি, কুতকুত, গোল্লাছুট, বউচি, টোপাভাতি, ডাংগুলি, দাড়িয়াবান্ধা, পুতুল খেলা, ফুল টোকা, বাঘ-ছাগল খেলা, মার্বেল খেলা, মোরগ লড়াই, লাটিম, ষোলো ঘুঁটি, এক্কাদোক্কা, এলাটিং-বেলাটিং, পানিঝুপ্পা, গোলাপ-টগর, রুমাল চুরি, ফুটবল, যুদ্ধ খেলা, ঘুড়ি ওড়ানোসহ হরেক রকম খেলা। কিন্তু এখন? এখন জাতীয় মানের দু’টি স্টেডিয়াম এবং হাতেগোনা কয়েকটি বড় মাঠ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো মাঠই নেই শহরে। বর্তমানে শহরের ছোট-বড় মাঠগুলোর মধ্যে আছে চুয়াডাঙ্গা পৌর স্টেডিয়াম, চুয়াডাঙ্গা পৌর টাউন ফুটবল মাঠ, চাঁদমারি মাঠ ও জাফরপুর স্টেডিয়াম। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা পৌর স্টেডিয়াম ও জাফরপুর স্টেডিয়াম মাঠে জাতীয় ও জেলাভিত্তিক খেলা অনুষ্ঠিত হয়। ফলে এ দু’টি মাঠ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। কিন্তু বাকি মাঠগুলো? এগুলোতে কি নগরের শিশু-কিশোররা খেলার পর্যাপ্ত সুযোগ পাই, এমন এক প্রশ্নের জবাবে এক শিশুসন্তানের অভিভাবক বলেন, ‘এসব খেলার মাঠ এখন মেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। বছরজুড়ে এসব মাঠে আয়োজন করা হয়ে থাকে বাণিজ্যমেলা, বস্ত্রমেলা, তাঁতমেলা, বৃমেলা, বিজয়মেলা, উন্নয়ন মেলা, বৈশাখী মেলা। একটি মেলা শেষ হলে মাঠ আবার ঘেরা হয় আরেকটি মেলার জন্য। ফলে খেলার মাঠে আমাদের সন্তানদের খেলাধুলার কোনো সুযোগই নেই।’
সোয়াদ বাবু নামের এক শিশুসন্তানের বাবা সুমন পারভেজ খান আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘এখন শহরে আর কোনো জমি ফাঁকা নেই। শিশুদের খেলাধুলার জন্য ভরসা শুধু স্কুলের মাঠ। কিন্তু সেগুলোও ঠিকমতো দেখভাল করা হয় না। আবার অনেক শিাপ্রতিষ্ঠানে মাঠই নেই। খেলার মাঠ কমে যাওয়ার নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর। তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ছে কম্পিউটার-মোবাইলে, খেলছে নানা ধরনের গেসমস।’
শিশু-কিশোর ও তরুণরা খেলাধুলা করার সুযোগ না পাওয়ায় ক্রমেই যুক্ত হচ্ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। বাড়ছে কিশোর অপরাধ। কমছে সুষ্ঠু ও সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশুদের মানসিক বিকাশ। মাঠ না থাকায় তরুণ-কিশোররা দিনরাত ব্যস্ত থাকছে প্রযুক্তি পণ্যের ওপর। তাদের জন্য কম্পিউটার, মোবাইল ও ট্যাব পরিণত হয়ে উঠেছে অনেকটা খেলার মাঠে। পাবজি, কাস ওফ কান, অনলাইন লুডোসহ নানা ধরনের গেমসের প্রতি তারা আসক্ত হয়ে পড়ছে। এসব প্রযুক্তিপণ্যেই তারা বেশি সময় ব্যয় করছে। বিপথগামী হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। এ কারণে শিশু-কিশোররা অল্প বয়সেই শারীরিক নানা সমস্যায় পড়ছে। শরীরে বাসা বাঁধছে নতুন নতুন রোগ। কম বয়সী শিশুদেরও ব্যবহার করতে হচ্ছে চশমা।
এখন মাঠ না থাকায় শহরের বিভিন্ন এলাকার গলি-উপগলিতেই খেলতে দেখা যায় কিশোরদের। শহরের সচেতন নাগরিকের দাবি, ‘এখন সময় এসেছে বিষয়টি নিয়ে ভাবার, সিদ্ধান্ত নেয়ার, পরিকল্পিত নগর গড়ার এবং আগামী প্রজন্মের প্রয়োজনীয় বিকাশ নিশ্চিত করার; অন্যথায় নেতিবাচক পরিবেশেই বড় হতে হবে আমাদের সন্তাদের। চরম খেসারত দিতে হবে জাতিকে।
চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য খেলার মাঠ, খেলাধুলার বিকল্প নেই। নগরায়ন ও ছোট ছোট ফাঁকা স্থানে নতুন নতুন বাড়ি তৈরির কারণে খেলার মাঠ যেমন কমছে, আবার দেখা যায় যেখানে খেলার মাঠ আছে সেখানে শিশু-কিশোররা খেলতে যায় না। কারণ তাদের বাবা-মা মাঠে গিয়ে অন্য শিশুদের সাথে খেলার চাইতে ঘরের চার দেয়ালের সঙ্কীর্ণতাকে সন্তানের জন্য অধিক নিরাপদ মনে করেন।
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘বিজ্ঞান প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন স্মার্টফোনের যুগ চলছে, পৃথিবীটা চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। এখন প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে সময়ও কমেছে। আকাশ সংস্কৃতি ও স্মার্টফোন তাদের সময় কেড়ে নিয়েছে। এখন এক দিকে খেলার মাঠ নেই, সময়ও নেই। অন্য দিকে খেলার ইচ্ছাও নেই। সব ইনস্টিটিউট, স্কুল, মাদরাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলার মাঠ রাখা অত্যাবশ্যক এবং প্রত্যেকের অভিভাবকদের তাদের সন্তানদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে।’

 


আরো সংবাদ



premium cement