২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`
হাওরের ফসল রক্ষাবাঁধের স্থায়িত্ব নিয়ে শঙ্কা

পুরনো বাঁধের ওপর ফেলা হচ্ছে মাটি, অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ নিয়ে চলছে সমালোচনা

সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে হাওরের ফসল রক্ষাবাঁধ নির্মাণে ৬ ইঞ্চি গর্ত না করে ও ঘাস না সরিয়েই মাটি ফেলা হচ্ছে। এতে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা হনয়া দিগন্ত -

সুনামগঞ্জের হাওরে বোরো ফসল রক্ষাবাঁধ নির্মাণকাজে অনিয়ম ও অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দের বিস্তর অভিযোগ
ওঠেছে। এ ছাড়া অনেক বাঁধে অনেক বেশি বরাদ্দ থাকায় জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। জামালগঞ্জের বাঁধ নির্মাণকাজে বরাদ্দ ও পিআইসি গঠন নিয়ে অনিয়মের লিখিত অভিযোগ রয়েছে। অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দের পাশাপাশি অযোগ্যদের দিয়ে পিআইসি গঠন করায় উপজেলা কাবিটা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটি বিতর্কিত হচ্ছে। সম্প্রতি জামালগঞ্জ উপজেলার হাওর রক্ষাবাঁধ নির্মাণে পিআইসি ও সাংবাদিকদের নিয়ে এক আলোচনা সভায় সুনামগঞ্জের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক ও জেলা হাওর রক্ষাবাঁধ বাস্তবায়ন কমিটির কর্মকর্তা এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলীর উপস্থিতিতে উপজেলা চেয়ারম্যান ইউসুফ আলা-আজাদ কোনো কোনো বাঁধে বেশি বরাদ্দের অভিযোগ তোলেন। গত বছর জামালগঞ্জে ৫৩টি পিআইসির বরাদ্দ ছিল ছয় কোটি ৭৭ লাখ টাকা। চলতি বছর ১৬টি বাড়িয়ে ৬৯টি পিআইসির জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রায় সাড়ে আট কোটি টাকা।
হাওরের কৃষকরা বলেছেন, এই পিআইসি বাণিজ্যে লাভবান হবে তারাই যারা তালিকার বাইরে থেকেও পিআইসি নামধারী অকৃষিজীবী আর্থিক সামর্থ্যহীন মানুষগুলোকে ব্যবহার করছেন। কিছুদিন আগে জেলা প্রশাসক বরাবরে ৪০ নম্বর পিআইসির আওতাভুক্ত জামালগঞ্জ-সুনামগঞ্জ সড়কের নোয়াগাঁওয়ের খাল ও সুরমা তীরবর্তী উজ্জ্বলপুর-জাল্লবাজ মধ্যস্থলের বাঁধের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার সিলেট বাবারে অভিযোগ দেন শাহ্ মোহাম্মদ আবুল কাশেম। অভিযোগের পর সরেজমিন ঘুরে দেখে ও স্থানীয় কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ছোটছোট ভাঙার জন্য যে ১৭ লাখ ৪৭ হাজার ৭৭৯ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয়। সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের পেট ভরাতেই এমন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। অন্য দিকে অভিযুক্ত ৩৯ নম্বর পিআইসির আরো আট লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। এলাকার প্রবীণ এক ব্যক্তি বলেন, ‘চাচা এই হানে অত টেহার বরাদ্দ কিয়ের লাগি দিছে? কোনো দিন দেখি নাই খাল দিয়া হাওরে ফানি যাইতে। এই টেহা কই যাইবো আল্লাই জানে।’ ওয়ার্ড মেম্বার বাবুল মিয়া জানান, এই ছোটখাটো কাজের জন্য এত টাকা বরাদ্দ কেনো দেয়া হলো বিষয়টি নিয়ে এলাকায় সমালোচনা চলছে। ভীমখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান শাহ বলেন, এই বরাদ্দটা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। এর সামনে এলজিইডির পাকা রাস্তা আছে। হঠাৎ যদি বাঁধ দিতেই হয় তাহলে এত টাকা বরাদ্দের প্রয়োজন নেই। এ ছাড়াও উপজেলার পাকনা হাওর ও হালির হাওরে বেশি বরাদ্দের অনেক প্রকল্পে ঘাস না সরিয়েই নীতিমালা না মেনে বাঁধের ওপর মাটি ফেলা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৪ নম্বর পিআইসি সভাপতি ছুরত জামানের অধীনে শনির হাওর উপ-প্রকল্পের জন্য যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। ২৩ লাখ ৫৪ হাজার ৭২২ টাকায় বরাদ্দকৃত এই পিআইসি মূলত অন্য আরেকজনের। সেখানে তালিকাভুক্ত ছুরত জামানকে কেবল কাজের লোক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ রকম অবস্থা প্রায় বেশির ভাগ পিআইসির। ৪ নম্বর পিআইসি সভাপতি ছুরত জামান বলেন, ‘যেরা বরাদ্দ দিছে হেরা জাইন্যাই দিছে। এইখানে কাজ করতে বেশি টেকা দরকার, হের জন্যই বরাদ্দ বেশি দেওয়া হইছে, বুজ্জইনি।’
হালির হাওর উপ-প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত ৬০ নম্বর পিআইসি সভাপতি বেহেলী ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দা নিরঞ্জন রায় একজন ফেরিওয়ালা। গ্রামে গ্রামে ফেরি করে পণ্য বিক্রি করাই যার প্রধান পেশা। তাকেই পিআইসির সভাপতি করা হয়েছে। দেয়া হয়েছে ২৪ লাখ ৫৪ হাজার টাকার বিশাল বরাদ্দ। শুধু তাই নয়, এ রকম অনেক পিআইসি নিয়েই সমালোচনার শেষ নেই। এ ব্যাপারে পিআইসি সভাপতি নিরঞ্জন রায় বলেন, ‘এই কাজডা আমারে দেওয়া হইছে, আমিই করতাছি। আমার সাথে কেউ সম্পৃক্ত নাই।’
এ পিআইসিতে গিয়ে দেখা যায়, বাঁধের ঘাস না সরিয়েই দেদারসে মাটি ফেলা হচ্ছে। মানা হচ্ছে না কোনো নিয়মনীতি। অভিযুক্ত ৪০ নম্বর পিআইসি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি প্রিয়াঙ্কা পাল বলেন, গত দুই বছর এখানে কাজ করা হয়েছে। এটা নতুন কোনো প্রজেক্ট নয়। আর এই অংশটা পাউবোর আওতাভুক্ত। ৬০ নম্বর পিআইসির সভাপতিকে নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তিনি কৃষক, হাওরে তার জমি আছে। কাজও প্রায় অর্ধেক শেষ করে ফেলেছেন তিনি।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান ইউসুফ আল আজাদ বলেছেন, এ সম্পর্কে বলে আর কি হবে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম একটা, রাতের অন্ধকারে ঘটে গেল আরেকটা।
অন্য দিকে সুনামগঞ্জের ১৩ হাজার হেক্টর জমি শনির হাওরে ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল লালুর গোয়ালার দুর্বল বাঁধ ভাঙা শুরু হতে না হতেই পুরো হাওর ডুবে যায়। লাখো কৃষক কান্নায় ভেঙে পড়েন। শনির হাওরে তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও বিশ^ম্ভরপুর উপজেলার কৃষকদের জমি। লালুর গোয়ালার ক্লোজারে কাজই ধরেননি পিআইসির লোকজন। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা বলেছেন, বাঁশের কাজ শুরু হয়েছে, দ্রুতই বাঁধের মাটির কাজও শুরু হবে।
জেলা হাওর রক্ষা বাঁধ বান্তবায়ন কমিটির কর্মকর্তা ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক এমরান হোসেন বলেছেন, লালুর গোয়ালাসহ গুরুত্বপূর্ণ বাঁধে এখনই মাটির কাজ শুরু না হলে, নন পিআইস গঠন করে কাজ শুরু হবে। শনির হাওরের এই ক্লোজারটি তাহিরপুর-জামালগঞ্জ-ধর্মপাশা ও বিশ^ম্ভরপুর উপজেলার জন্য বিপজ্জনক। এখানে এখন পর্যন্ত কাজ শুরু না হওয়ায় উৎকণ্ঠায় আছেন কৃষকরা। জামালগঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত পাউবোর উপ-সহকারী প্রকৌশলী রেজাউল কবীর বলেন, লালুর গোয়ালায় বাঁশ পোঁতা শুরু হয়েছে। মাটিরকাজ দুই-এক দিনের মধ্যে শুরু হবে।
জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রিয়াঙ্কা পাল বললেন, শনির হাওরের লালুর গোয়ালা দুই উপজেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্লোজার। আমরা এটি দ্রুত করার জন্য বলে দিয়েছি। পানি নামতে বিলম্ব হওয়ায় ওখানে বাঁধের কাজ শুরু করতে বিলম্ব হচ্ছিল। দুই-এক দিনের মধ্যে ক্লোজারে মাটি ভরাট শুরু হবে। শনির হাওরের লালুর গোয়ালাই কেবল নয়, বিশ^ম্ভরপুর মাটিয়ানী হাওরের তলানীর উপজেলাগুলোর অনেক বড় বড় ক্লোজারে এ পর্যন্ত কাজই শুরু হয়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সাবিবুর রহমান বলেন, ১৩৫টি ক্লোজারের মধ্যে ৬৩টিতে কাজ শুরু হয়েছে। তাহিরপুরের শনির হাওর ও মাটিয়ান হাওরে মঙ্গলবার গিয়ে আমাদেরও খারাপ লেগেছে। আমরা জানিয়ে দিয়েছি দুই-এক দিনের মধ্যে যেসব বাঁধে পিআইসিরা কাজ শুরু করবেন না, তাদের পিআইসি বাতিল করা হবে। নতুন করে পিআইসি গঠন করে কাজ করা হবে।
জেলা হাওর রক্ষাবাঁধ বাস্তবায়ন কমিটির কর্মকর্তা ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক এমরান হোসেন বলেন, দুই-এক দিনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বাঁধগুলোতে কাজ শুরু না হলে সংশ্লিষ্ট পিআইসি বাতিল করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানিয়ে দেয়া হবে। যারা কাজ শুরু করতে পারবে তাদের দিয়ে নতুন পিআইসি গঠন করে কাজ করানো হবে।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement