২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র ছৈলার চর

-

বিষখালী নদীর জলরাশির মধ্যে এক টুকরো সবুজ। প্রকৃতি যেন সব সৌন্দর্য এখানে উজাড় করে দিয়েছে। নৈসর্গিক সৌন্দর্যময় এ ভূখণ্ডের নাম ছৈলার চর। সুন্দরবনের মতোই প্রাকৃতিকভাবে কাঁঠালিয়ার অবহেলিত চরাঞ্চলে বেড়ে উঠেছে ছৈলা গাছ। ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া বন্দরে নেমে নৌকা অথবা ট্রলারে যেতে হয় ছৈলার চরে।
উপকূলীয় জেলা ঝালকাঠির দক্ষিণ জনপদ কাঁঠালিয়ায় বিষখালী নদীর তীরে মনোরম দর্শনীয় স্থান ছৈলার চরে পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও রয়েছে নানা সঙ্কট। যাতায়াতেও ভোগান্তি কম নয়। তবু সঙ্কট উপেক্ষা করেই এটি পর্যটকদের মিলনমেলায় পরিণত হচ্ছে। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সুন্দরবনের মতোই দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে ছৈলার চর।
জানা যায়, বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার দূরে কাঁঠালিয়া উপজেলার হেতালবুনিয়া মৌজায় বিষখালী নদীতে এক যুগেরও আগে ৩০.৬১ একর জমি নিয়ে জেগে উঠেছে এই বিশাল চর। এখানে রয়েছে লক্ষাধিক ছৈলা গাছ। আর ছৈলা গাছের নাম থেকেই এ চরের নামকরণ হয়েছে ‘ছৈলার চর’। শীতের সময় শুকনো চরে গহিন অরণ্য। যেন চারপাশে নদীঘেরা যেন ছৈলার বনের দ্বীপ। ছৈলা গাছে পাখিরা বাসা বেঁধেছে। অতিথি পাখিও নিরাপদ স্থান মনে করে আশ্রয় নিয়েছে। দেশীয় পাখি তো আছেই। ছৈলা ছাড়াও এখানে কেয়া, হোগল, রানা, এলি, মাদার, আরগুজিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সমারোহ।
প্রতি বছর শীত ও শুকনো মৌসুমে ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠছে ছৈলার চর। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি আয়োজনে মানুষ ছুটে আসছে ছৈলার চরে। ২০১৪ সালে ছৈলার চরকে পর্যটনস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছে জেলা প্রশাসন। কিন্তু এখানে সুপেয় পানির ব্যবস্থা এবং শৌচাগার না থাকায় পর্যটকদের পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। তবে এসব সুযোগ-সুবিধা তৈরি করতে পর্যটন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে।
বছরখানেক আগে উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ থেকে ছৈলার চরকে পূর্ণাঙ্গ বিনোদনস্পটে রূপ দিতে অভ্যন্তরীণ একটি পুকুরে ঘাটলা, একটি টিউবয়েল, তিনটি শৌচাগার, একটি শেড ও একটি রান্নাঘর স্থাপন করা হয়। কিন্তু গত ১০ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে আছে। সমস্যা সমাধান না হওয়ায় পর্যটকরা পড়ছেন ভোগান্তিতে।
কাঁঠালিয়া লঞ্চঘাট থেকে নৌপথে যেতে হয় ছৈলার চরে। আমুয়া বন্দর থেকেও ট্রলারে কিংবা অন্য কোনো নৌযানে যাওয়া যায়। সড়কপথে হেতালবুনিয়া আলিম মাদরাসার সামনে কেল্লা পর্যন্ত যাওয়া যায়। পর্যটন এলাকাকে ঘিরে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও রেস্ট হাউজ করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
ছলার চর ঘুরতে আসা মহসিন খান বলেন, ছৈলা গাছের ফল সবুজ। এর ফুলে সাদা-লাল সংমিশ্রণ রয়েছে। এ ফুলের গোড়া কেটে রাতে ভিজিয়ে রাখলে সকালে মধু জমে ফুলের গোড়ায়। উপকূলীয় অঞ্চলের কিশোর-কিশোরীদের কাছে এ ফুলের মধু বেশ প্রিয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ম্যানগ্রোভ জাতীয় এ উদ্ভিদ নদীভাঙন রোধে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাছাড়া সিডরের সময় উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষায় ছৈলাবনের বিশেষ ভূমিকা ছিল। যদিও সিডরের আঘাতে হাজার হাজার ছৈলা গাছ ভেঙে যায়।
ঢাকা কলেজের মাস্টার্সের ছাত্র রবিউল ইসলাম বলেন, ছৈলা গাছ ম্যানগ্রোভ জাতীয় উদ্ভিদ। উপকূলীয় এলাকার নদী ও খালের পাড়ে এ গাছ বেশি জন্মায়। সাধারণত জোয়ার-ভাটার পানি থাকে এমন এলাকায় বেশি দেখা যায়। উদ্ভিদটি তুলনামূলক কম লবণাক্ত মাটিতে জন্মে। এর শেকড় মাটির অনেক গভীর যায়। ফলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা থেকে উপকূলীয় জনসাধারণের জানমাল রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখে এই গাছ। সুন্দরবন অঞ্চলজুড়ে এই গাছের দেখা মেলে। তবে বিশখালী ও বলেশ্বর নদের দুই পাড়েই রয়েছে অনেক ছৈলা গাছ। এই গাছের টকজাতীয় ফলটি কাঁচা, পাকা ও রান্না করা অবস্থায় খাওয়া যায়। এমনকি এ ফল দিয়ে জেলিও তৈরি হয়। এখানে পর্যটন শিল্পের পাশাপাশি ছৈলা গাছের ওপর নির্ভর করে অনেক ধরনের খাদ্য তৈরির সম্ভাবনাও আছে।
ছৈলার চরের পর্যটক তাসীন মৃধা অনিক বলেন, সুন্দরবনের মতোই অনেক দৃষ্টিনন্দন এ চর। পর্যটকদের জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা করে দিলে ভ্রমণপিপাসুরা আরো স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। তিনি এখানকার নিরাপত্তা বাড়ানোর পাশাপাশি মূল ভূখণ্ডের সাথে চরের সড়ক যোগাযোগের জন্য সেতু নির্মাণের দাবি জানান।
কাঁঠালিয়া সদর ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম কবির সিকদার বলেন, এখানে পর্যটনের সম্ভাবনা থাকলেও এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। অবকাঠামোগত কিছু না থাকায় সরকার রাজস্ব পাচ্ছে না। এটি যদি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যায় তাহলে সরকার রাজস্ব পাবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দীন বলেন, ছৈলার চরকে নিয়ে প্রশাসনের অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে ট্যুরিজম বোর্ড ছৈলার চর উন্নয়নের লক্ষ্যে কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব করেছে। মন্ত্রণালয় অনুমোদন করলেই এর বাস্তবায়ন শুরু হবে।
ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক জোহর আলী বলেন, ছৈলার চর পর্যটন শিল্পের জন্য খুব সম্ভাবনাময় একটি জায়গা। এখানে পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে পর্যটন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে ছৈলার চরকে নান্দনিকরূপে সাজানো হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement