মৌচাষির অভাবে ফুলেই শুকিয়ে যাচ্ছে আড়াই কোটি টাকার মধু
- শফিউল আযম বেড়া (পাবনা)
- ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০
পাবনার ফসলের মাঠে মাঠে এখন হলুদ সরিষা ফুলের সমারোহ। মাঠের পর মাঠ যেন হলুদের গালিচা বিছানো। থোকা থোকা হলুদ ফুল আকৃষ্ট করছে মৌমাছি ও প্রকৃতিপ্রেমীদের। মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে দিগন্ত বিস্তৃত সরিষাক্ষেত। তবে প্রয়োজনীয় মৌচাষির অভাবে পদ্মা-যমুনার চরাঞ্চলে প্রায় আড়াই কোটি টাকার মধু শুকিয়ে যাচ্ছে ফুলেই।
পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি রবি মৌসুমে পাবনায় ৩১ হাজার ৯৪২ হেক্টর জমিতে আগাম ও নাবি জাতের সরিষাচাষ হয়েছে। তবে জেলার চরসাফুল্লা, চরপেচাকোলা, চরআড়ালিয়া, সাঁড়াশিয়া, কল্যাণপুর, চরসাফুলা, চরনাগদা, চরঢালা, চরকল্যাণপুর, পূর্ব শ্রীকণ্ঠদিয়া, পদ্মারচর, চামতারা, শিংঘুলি, ভারদিঘুলিয়া, চরবলরামপুর, চরভাড়ারা, সাদিপুর, সুদিরাজপুর, আশুতোষপুরসহ ছোট-বড় ৩০টি চরে সরিষার সবচেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে। তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে চলতি মৌসুমে প্রতি হেক্টরে দেড় টন হিসেবে সরিষার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৪৮ হাজার টন। সেই সাথে ২৫০ টন মধু উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু চরাঞ্চলে মৌচাষির অভাব থাকায় সরিষা ফুলের আড়াই কোটি টাকার মধু ফুলেই শুকিয়ে যাচ্ছে।
যমুনা ও পদ্মা নদী বেষ্টিত উপজেলার কল্যাণপুর চরের কৃষক আদম আলী প্রামাণিক জানান, তিনি তিন বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছেন এবং এতে তার খরচ হয়েছে ১০ হাজার থেকে ১৩ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ভালো ফলন হলে প্রতি বিঘায় ছয় থেকে সাত মণ সরিষা উৎপাদন হয়। প্রতি মণ সরিষার বাজারমূল্য দুই হাজার ১০০ টাকা থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা। অন্যান্য ফসল আবাদ করে প্রতি বিঘায় যে লাভ হয় ওই পরিমাণ জমিতে সরিষা চাষ করে তার দ্বিগুণ লাভ করা যায়। সরিষা যেমন দিচ্ছে তেল, সাথে দিচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এ ছাড়া সরিষার ফুল ও পাতা ঝড়ে তৈরি হয় জৈবসার। এতে কৃষকরা এখন ধান ও অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি সরিষা চাষের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছেন। পাবনার সাঁথিয়ার সোনাতলা গ্রামের কৃষক আজিজার রহমান জানান, তিনি পাঁচ একর জমিতে সরিষা আবাদ করে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন। আট বছর ধরে সরিষা চাষ করে তিনি প্রতি মৌসুমে দুই থেকে সোয়া দুই লাখ টাকা লাভ করেছেন। এবার আরো বেশি লাভের আশা করছেন।
এ দিকে ইউরোপিয়ান হাইব্রিড এপিস মেলিফেরা মৌমাছির মৌ মৌ গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে গোটা চরাঞ্চল। ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি উড়ে গিয়ে সরিষা ফুলে বসছে। কিছুক্ষণ পরপর মধু নিয়ে উড়ে এসে মৌমাছির দল ফিরছে মৌবাক্সে। মৌমাছির বিচরণে সঠিকভাবে সরিষার ফুলে পরাগায়ণ ঘটছে। তাতে সরিষার উৎপাদনক্ষমতা বেড়ে গেছে অনেক। এতে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। শুধু তা-ই নয়, পরিবেশবিদরা বলছেন ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহার কম হওয়ায় উপকৃত হচ্ছে পরিবেশ। মৌমাছি শুধু মধুই সংগ্রহ করে না, ফসলের জন্য ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ মেরে ফেলে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষকদের সহায়তা করে থাকে।
খুলনার মৌচাষি জসিম সরদার জানান, এবার পাবনা অঞ্চলে যে পরিমাণ সরিষার চাষ হয়েছে তাতে পর্যাপ্ত মৌচাষি থাকলে পাঁচ কোটি টাকার মধু সংগ্রহ করা সম্ভব। তার দু’টি গ্রুপে ৩৪০ মৌবাক্স আছে। ৩৪০টি মৌবাক্সে এক মাসে ১৫৪ মণ মধু সংগ্রহ করা যাবে। যার বাজারমূল্য প্রায় ১৬ লাখ টাকা। পাবনার সমতল এলাকায় শতাধিক মৌচাষির দল গত বছর প্রায় ছয় কোটি টাকার মধু সংগ্রহ করেছেন বলে তিনি জানান। শুধু মৌচাষির অভাবে ছোট-বড় ৩০টি চরে সরিষা ফুলের প্রায় আড়াই কোটি টাকার মধু ফুলেই শুকিয়ে যাচ্ছে।
বগুড়া, রংপুর, নাটোর, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, খুলনা, টাঙ্গাইল, যশোর, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শতাধিক ভ্রাম্যমাণ মৌচাষি পাবনার প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। তাদের সংগৃহীত মধু রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয়ে থাকে।
সাতক্ষীরা থেকে পাবনার সুজানগর উপজেলার গাজনার বিলে মধু সংগ্রহ করতে আসা শিমুল বিশ্বাস বলেন, প্রায় পাঁচ বছর ধরে তিনি মধু আহরণ করছেন। গত বছর দুই টন মধু আহরণ করেছিলেন, এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় তিন টনের বেশি মধু সংগ্রহ করতে পারবেন বলে আশা করছেন। মৌচাষিরা জানান, বছরের সাত মাস বিভিন্ন প্রজাতির ফুল থেকে মধু পাওয়া যায়। সরিষার পর লিচু, আম, ধনিয়া, তিল-তিসিসহ বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা হয়। বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে মধু সংগ্রহের পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার কেজি। প্রতি কেজি মধু ২৫০ টাকা দরে মাঠেই অগ্রীম বিক্রি হচ্ছে। এ অঞ্চলে উৎপাদিত ভেজালমুক্ত মধুর গুণগত মান খুবই ভালো। এ জন্য বিখ্যাত প্রাণ কোম্পানি এবং স্কয়ার, এপি, এসিআইসহ নামকরা কোম্পানিগুলোর এজেন্টরা মাঠ থেকে অপরিশোধিত মধু অগ্রীম কিনে নেন।
সাঁখিয়া উপজেলার বিলসলঙ্গী মাঠে মধু সংগ্রহে এসেছেন বগুড়ার আলেক আলী ও নাটোরের সানাউল হক। তারা জানালেন মধু সংগ্রহ করে তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার কাহিনী। তাদের বাক্সের সংখা ৩৫২টি। প্রতি মণ মধু ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা দরে বিক্রি করেন ঢাকার নবাবপুর ও যাত্রাবাড়ীতে। তারা বলেন, উন্নত প্রশিক্ষণ আর সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মধু সংগ্রহের কাজে অনেক উন্নতি করতে পারবেন। দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশে মধু রফতানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব বলে তারা মনে করেন।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক আজাহার আলী বলেন, সদর, বেড়া, সাঁথিয়া, সুজানগর, ঈশ্বরদী, আটঘড়িয়া, চাটমোহর, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া উপজেলায় ৩১ হাজার ৯৪২ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে। এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় জেলায় সরিষার আশাতীত ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। গত বছর ফলন বাড়ানোর জন্য ক্ষেতের পাশে মৌবাক্স বসানো হয়েছিল। মৌমাছি পরাগায়ণে সহায়তা করেছে। ফলে সরিষার ফলন বেড়েছে। এ পদ্ধতিতে লাভবান হয়েছেন কৃষক ও মৌ ব্যবসায়ী উভয়েই।
বেড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মসকর আলী জানান, পদ্মা ও যমুনা চরের মাটি বেলে ও দোআঁশ হওয়ায় পানি ধারণক্ষমতা কম। মাটির পানি ধারণক্ষমতা কম হলে জৈব সারের প্রয়োজন হয়। সরিষা চাষ করলে খাবার তেলের চাহিদা পূরণ ছাড়াও সরিষার পাতা ও ফুল ঝড়ে পড়ে জৈবসার তৈরি করে। এতে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা