১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চলনবিলে মাছ সঙ্কটে শুঁটকি উৎপাদন ব্যাহত

তারাশের মহিষলুটিতে মাছের অভাবে শুঁটকির চাতাল ফাঁকা পড়ে আছে হনয়া দিগন্ত -

পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে গঠিত মৎস্য ভাণ্ডার চলনবিলের প্লাবন ভূমিতে চলতি শুঁটকি মৌসুমে তাজা মাছের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, ফসলি জমিতে অতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ, অবাধে মা মাছ শিকার এবং শুষ্ক মৌসুমে বেশির ভাগ নদী-বিল-খাড়ির বেশির ভাগ এলাকা শুকিয়ে যাওয়ায় মাছের বংশবিস্তার ও উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। চলনবিলে দেশী প্রজাতির মাছ ধরা ও শুকানোর এই ভরা মৌসুমে বেশির ভাগ শুঁটকি চাতালে তাজা মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে এ বছর শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। এ দিকে মহাজনের কাছ থেকে দাদনে টাকা নিয়ে শুঁটকি চাতালে বিনিয়োগ করে লোকসানের আশঙ্কায় চাতাল মালিকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
একটা সময় ছিল যখন চলনবিলের মাছ স্থানীয় অর্থনীতি ও জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলত। মাছ বিক্রি করে আর্থিকভাবে সচ্ছল হয় এ অঞ্চলের মানুষ। ১৯১৪ সালে চলনবিলের মাঝ দিয়ে প্রথম ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মিত হয়। তখন চলনবিলের সাথে কলকাতার যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ওই সময় ট্রেনে করে মাছ যেত কলকাতায়। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৭ সালে চলনবিলের মাঝ দিয়ে বাঘাবাড়ী থেকে সিংড়া পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ২০০২ সালে চলনবিলের বুক চিরে নির্মাণ করা হয় ৫৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বনপাড়া-হাঁটিকুমরুল-যমুনা সেতু সংযোগ সড়ক। চলনবিলে এক হাজার ৮৮ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে বেঁচে আছে ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে মাত্র ৮৬ বর্গকিলোমিটার এলাকায় সারা বছর পানি থাকে। পানি সরে গেলে বিল-নদী-খাড়িগুলোর বেশির ভাগ এলাকা শুকিয়ে প্রজনন ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়ে হওয়ায় মাছের বংশবিস্তার মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে স্থানীয় জেলেরা জানিয়েছেন।
জানা গেছে, চলনবিলে মোট প্রায় ছয় হাজার ০৪৩ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল ও ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খাড়িসহ অসংখ্য পুকুর রয়েছে। বন্যার পানি নেমে গেলে এসব বিল নদী খাড়ি শুকিয়ে হাজার হাজার হেক্টর সমতল ভূমি জেগে ওঠে। স্থানীয় কৃষকরা জেগে ওঠা জমিতে সরিষা, গাজর, রসুর, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ করেন। ফসল আবাদে তারা মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক প্রযোগ, জলবায়ু পরিবর্তন, নদীতে যত্রতত্র বাঁধ দিয়ে পানিপ্রবাহ আটকে দেয়া, অবাধে মা মাছ নিধন, প্রজনন ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হওয়া এবং শুষ্ক মৌসুমে বিল-নদী-খাড়ি শুকিয়ে যাওয়ায় চলনবিল অঞ্চলে মাছের উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে।
দেশী মাছকে কেন্দ্র করে চলনবিলে গড়ে উঠেছে প্রায় ২৭০টি অস্থায়ী শুঁটকির চাতাল। গুরুদাসপুরের সাতগাড়ী গ্রামের ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিন শুঁটকির চাতাল গড়েছেন তারাশের মহিষলুটি এলাকায়। তিনি জানান, গত বছর তার দু’টি চাতালে এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৪০০ মণ শুঁটকি উৎপাদন হয়েছিল। সৈয়দপুর, নীলফামারীসহ বিভিন্ন এলাকার শুঁটকি ব্যবসায়ীরা এসে চাতাল থেকেই শুঁটকি মাছ কিনে নিয়ে যায়। তবে এ বছর চলনবিলের প্লাবন ভূমিতে মাছ ধরা পড়ছে কম।
পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে ২৭০টি চাতালে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা মূল্যের ৪০০ মেট্রিক টন থেকে ৪৫০ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সাড়ে চার শ’ মণ শুঁটকি উৎপাদনে প্রায় এক হাজার ৩৫০ মেট্রিক টন কাঁচা মাছের প্রয়োজন। এ দিকে চলতি শুঁটকি মওসুমে চলনবিলের প্লাবন ভূমিতে জেলেদের জালে পর্যাপ্ত পরিমাণ মাছ ধরা পড়ছে না। শুঁটকি মাছ মানভেদে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ গ্রেডে বাছাই করা হয়। ‘এ’ গ্রেডের (ভালো মানের) শুঁটকি মাছ প্রক্রিয়াজাত করে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, বাহরাইন, দুবাই, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হয়। সাধারণত এসব দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিদের মাঝে রয়েছে চলনবিলের শুঁটকি মাছের আলাদা কদর।
তা ছাড়া ‘সি’ ও ‘বি’ গ্রেডের শুঁটকি মাছ দেশের ভেতরে দিনাজপুর, সৈয়দপুর, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা, নারায়নগঞ্জ ও চট্টগ্রামে উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়ে থাকে চলনবিলের শুঁটকি মাছ। সৈয়দপুরের শুঁটকি ব্যবসায়ী এখলাছ মিয়া জানান, চলনবিলের শুঁটকি মাছের মান ভালো। তাই দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলনবিলের মিঠা পানির শুঁটকি মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এ বছর মাছের উৎপাদন কম হওয়ায় চাহিদার অর্ধেক শুঁটকি মাছও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বিদেশে শুঁটকি মাছ রফতানি করা সম্ভব নাও হতে পারে বলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
জানা যায়, চলনবিলের দুই সহস্রাধিক পরিবার শুঁটকি তৈরির কাজে জড়িত রয়েছেন। এসব পরিবারের নারী-পুরুষ সদস্যরা দিন হাজিরায় কাজ করছেন শুঁটকি চাতালে। কাজের ধরন অনুয়ায়ী তারা মজুরি পাচ্ছেন ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। এ কাজ করে তারা আর্থিকভাবে সচ্ছল হচ্ছেন। শুঁটকি তৈরির কাজে নিয়োজিত ননুয়াকান্দি গ্রামের সবিতা, তাহমিনাসহ বেশ কয়েকজন নারী ও পুরুষ শ্রমিক জানান, তিন কেজি তাজা মাছ শুকিয়ে এক কেজি শুঁটকি তৈরি করা হয়। প্রকারভেদে শুঁটকির বাজার মূল্য ৫০০ টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা।
বনপাড়া-হাঁটিকুমরুল মহাসড়কের তাড়াশ উপজেলার মহিষলুটি শুঁটকি মোকামের একাধিক আড়তদার জানিয়েছেন, এই মহাসড়ক নির্মাণের আগে চলনবিল থেকে আহরিত বিপুল পরিমাণ মাছ অবিক্রীত থাকত। এসব মাছ পরে শুঁটকি করা হতো অথবা ফেলে দেয়া হতো। তখন উদ্বৃত মাছ স্বল্প মূল্যে কিনে শুঁটকি তৈরি করে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে অনেক চাতাল মালিক আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। আর এখন উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা এসেছে চলনবিলের তাজা ও শুঁটকি মাছ কিনে ট্রাকে ভরে নিয়ে যান দেশের বিভিন্ন জেলায়। চলনবিলের দেশীয় প্রজাতির মাছের শুঁটকি তৈরির চাতালগুলো অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত চালু থাকে। মাছ রফতানিকারকরা শুঁটকি মাছ কিনে প্রক্রিয়াজাত করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করছেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement