১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পাট চাষ করে হতাশ যশোরের কৃষকেরা মণপ্রতি দাম কমেছে ৬ থেকে ৭ শ’ টাকা

যশোরের কেশবপুর উপজেলার গোপসেনা গ্রামে ডোবায় পচানো পাটের আশ ছাড়াচ্ছেন কৃষকেরা : নয়া দিগন্ত -

আধুনিক চাষ পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনে শতভাগ প্রকৃতিনির্ভর না হলেও ফসলের মান নিয়ে হতাশ কৃষক। নতুন ফসল ঘরে উঠতেই কমছে দাম। ফসল বিক্রি করে কৃষক দেনা পরিশোধ করতে হিমসিম খাচ্ছেন। অতীতে জমিদার-জোতদারদের ক্ষেতের ফসল দেখিয়ে দেনা পরিশোধে সময় নিতেন কৃষক। পাওনাদাররা অপেক্ষা করতেন; কিন্তু এখন আর দেনাদাররা অপেক্ষা করতে চান না। ফলে উঠতি ফসল কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন কৃষক। বোরো ধান চাষ করে ন্যায্যমূল্য না পেয়ে চরমভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল যশোরের কৃষককুল। বোরো চাষের সময় নেয়া ঋণ যখন তাদেরকে বিচলিত করে তুলেছিল তখন পাট চাষ করে কৃষক। স্বল্প খরচে উৎপাদন ও দাম বেশি পাওয়ার সম্ভাবনাকে সামনে রেখে আশাবাদী হয়েছিলেন তারা। কিন্তু আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় এবার পাটের ফলন ভালো হয়নি। আর দাম কমে যাওয়ায় সোনালি আঁশে সোনালি স্বপ্ন দেখা কৃষক এখন হতাশ। পাটের ন্যায্যমূল্যে থেকে এ বছরও বঞ্চিত যশোরের চাষিরা। নতুন পাট বাজারে ওঠার সাথে সাথে যশোরাঞ্চলের বিভিন্ন বাজারে দাম আগের চেয়ে মণপ্রতি ৫ শ’ থেকে ৬ শ’ টাকা কমে গেছে। পাটের দাম কম হওয়ায় তাদের বিঘাপ্রতি প্রায় চার হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। এতে চরম লোকসানের আশঙ্কা করছেন চাষিরা। ধারদেনা করে চাষ করা পাট এখন তাদের গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে জানা গেছে, গত মওসুমে যশোরের আট উপজেলায় ১৮ হাজার ১৩০ হেক্টর জমিতে পাট আবাদ করা হয়। এ বছর তা বেড়ে ২০ হাজার ৮১০ হেক্টর জমিতে পাট আবাদ হয়েছে। ধানের দরপতনের কারণে কৃষকেরা পাট চাষ বাড়িয়েছেন বলে কৃষি বিভাগ দাবি করছে।
কয়েক বছর ধরে ধান আবাদে লোকসান হওয়ায় এবং পাটের দাম কিছুটা বেশি হওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষক পাট চাষে ঝুঁকে পড়েন। তবে এ বছর চরম বৈরী আবহাওয়ার কারণে এক দিকে যেমন পাটের ফলন কম হয়েছে, অন্য দিকে পানির অভাবে পাট জাগ দেয়া নিয়ে কৃষকেরা অস্বস্তিতে ছিলেন। এরপরও চাষিরা আশা করছিলেন পাটের ন্যায্যমূল্যে পাবেন তারা। কিন্তু নতুন পাট বাজারে তোলার পর তারা চরম হতাশ হচ্ছেন দাম নিয়ে। নতুন পাট বাজারে ওঠার আগে পাটের দাম মণপ্রতি দুই হাজার থেকে ২২ শ’ টাকা থাকলেও এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১৪ শ’ থেকে ১৩ শ’ টাকায়। ফলে মণপ্রতি দাম কমেছে ৬ থেকে ৭ শ’ টাকা।
পাট ব্যবসায়ীরা বলেন, এ বছর নতুন পাট ওঠার সময় পাটের বাজার পড়ে গেছে। স্থানীয় বাজারে পাটের সরবরাহ থাকলেও আড়তদার ও ব্যবসায়ীর তা কেনার আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
কৃষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বলছেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কারণে প্রান্তিক কৃষকেরা পাটের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। এছাড়া পাটকল বন্ধ থাকায় পাটের চাহিদাও কমে গেছে। তাই সোনালি আঁশের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে দ্রুত দেশের সব পাটকল চালু করতে হবে। বন্ধ করতে হবে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। আর এজন্য মণপ্রতি পাটের মূল্য তিন হাজার টাকা নির্ধারণ করতে হবে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, গত মওসুমে ঘরে মজুদ করা পাট জুন মাসে বিক্রি করেছি প্রতি মণ দুই হাজার থেকে ২২ শ’ টাকা। তিনি বলেন, জুলাই মাসে তা কমে দাঁড়ায় ১৯ শ’ থেকে দুই হাজার টাকায়। আগস্ট মাসর প্রথম সপ্তাহে প্রতি মণ পাটের দাম ছিল এক হাজার ৭০০ টাকা। আর এখন তা বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৪০০ টাকায়। তিনি বলেন, বাইরে পাটের চাহিদা না থাকায় পাট বেচে কেনা নেই। ফলে আড়তদারা পাট কিনছেন না। ফলে পাটের দাম কমছে। দাম আরো কমতে পারে এ আশষ্কায় ব্যবসায়ীরা পাট কিনতে সাহস পাচ্ছেন না। ফলে সামনে পাটের দাম আর বাড়ার সম্ভাবনা নেই।
কেশবপুরের চাষি হাসান খান বাজারে জানান, পাটের দাম মণপ্রতি ১৩ শ’ থেকে ১৫ শ’ টাকা। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে এই পাট মণপ্রতি দুই হাজার টাকা বিক্রি হয়েছে।
ঝিকরগাছা উপজেলার কৃত্তিপুর গ্রামের মনোয়ার হোসেন জানান, একবিঘা জমিতে পাট চাষ, বীজ বপন, পরিচর্যা, কাটা, পচানো, আঁশ ছড়ানো, শুকানো ও বিক্রির জন্য পরিবহনসহ সর্বসাকুল্যে খরচ হয় প্রায় ১৫ হাজার টাকা। অথচ প্রতি বিঘায় পাটের ফলন হয়েছে ৮ থেকে ১০ মণ। বর্তমানে প্রতিমন এক হাজার ৩০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। ফলে বিঘাপ্রতি তিন থেকে চার হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদেরকে। তিনি বলেন, এমনিতেই ধান আবাদে লোকসান করেছি। এখন পাট আবাদেও লোকসান হবে। পাওনাদাররা আর ছাড়ছে না।
কৃষক হাসান খাঁ বলেন, কৃষি ঋণ আর দাদন নিয়ে চার বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছিলাম। গত বছর প্রথম দিকে পাটে দাম ভালো ছিল। ভেবেছিলাম এবারো ভালো দাম পাব। কিন্তু পাটের দাম এবার কম। ১৩০০ টাকায় পাট বিক্রি করলে উৎপাদন খরচ উঠবে না। তিনি জানান, বাজার দর ছাড়া ১০০ টাকা কমে দাদন মালিককে পাট দিতে হবে। এবার কৃষক শেষ।
পাট ব্যবসায়ী হুসাইন আল সাদিক সুমন বলেন, সরকারি মিলের রেট অনুযায়ী এবার সি গ্রেডের পাটের দাম ১৯৯০ টাকা। তবে এ বছর যশোরাঞ্চলে অপেক্ষাকৃত কম বৃষ্টি হওয়ায় পাটের মান অনেকটা খারাপ। যে কারণে মিলে সরবরাহকৃত পাট কিনতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন। তিনি বলেন, প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে এ অঞ্চলের চাষিরা তাদের নতুন পাট বাজারে তুলছেন। প্রথম দিকে ভালো মানের পাট দুই হাজার থেকে ১৯ শ’ টাকা বিক্রি হলেও মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে তা কমে ১৪ শ’ থেকে ১৫ শ’ টাকায় নেমে আসে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর যশোরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক সুষান্ত কুমার তরফদার বলেন, চলতি বছরে যশোরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি পাট আবাদ হয়েছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে পাটের ফলন ও জাগ দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো কোনো এলাকায় সমস্যা দেখা দিলেও শেষ পর্যন্ত কৃষক তার ক্ষেতের পাট ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। বাজারে বর্তমানে দাম কম হলেও কয়েক দিনের মধ্যে দাম বাড়বে বলে তিনি দাবি করেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement