১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কাজিপুরে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের ঘর নির্মাণে ব্যাপক দুর্নীতি

কাজিপুরে ‘জমি আছে ঘর নাই’ আশ্রায়ণ-২ প্রকল্প থেকে খাসরাজবাড়ি ইউনিয়নের বিলধলি গ্রামের নিলি খাতুনের নামে বরাদ্দকৃত ঘর ও ল্যাট্রিনের কাজ সম্পন্ন হয়নি : নয়া দিগন্ত -

সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অর্থে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে ‘জমি আছে ঘর নেই’ প্রকল্পে ২১৬টি ঘর নির্মাণে সাবেক ইউএনও বর্তমানে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালকের (ডিডিএলজি) বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্প পরিচালক বিষয়টি খতিয়ে দেখতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছেন। এ দিকে ঘর নির্মাণ না হওয়ায় বিপাকে পড়েছে অসহায় মানুষগুলো।
যমুনা নদীর করাল গ্রাসে বাস্তুভিটাহারা কাজিপুর উপজেলার অসহায় মানুষের একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে ‘জমি আছে ঘর নেই’ প্রকল্পে ২১৬টি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রতিটি ঘরের জন্য এক লাখ ১৯ হাজার টাকা হিসাবে দুই কোটি ৫৭ লাখ চার হাজার টাকার প্রকল্পের সুফল পায়নি সুবিধাভোগীরা। অভিযোগ রয়েছে, সে সময় দায়িত্বে থাকা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শফিকুল ইসলাম নিয়মের তোয়াক্কা না করে নিজেই ঘরগুলো নির্মাণ করার উদ্যোগ নেন। তিনি প্রকল্পের সভাপতি আর উপজেলা বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) সদস্যসচিব ও কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাকে সদস্য করে ঘর নির্মাণের কাজ শুরু করেন। নি¤œমানের কাঠ, টিন আর ইট-সিমেন্ট দিয়ে কিছু ঘর নির্মাণ করলেও তালিকায় ঘর পাওয়া বেশ কয়েকজনের বাড়িতে কোনো প্রকার কাজই করা হয়নি।
উপজেলার ঝুমকাইল হিন্দুপাড়া গ্রামের সুনিল চন্দ্র দাস এবং বীর শুভগাছা গ্রামের রোকেয়া বেগম জানান, ঘর পাওয়ার তালিকায় তাদের নাম থাকলেও বাস্তবে তারা ঘর পাননি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঘরের খুঁটি লাগিয়ে মিস্ত্রি ও কাঠ ব্যবসায়ীদের বিল বকেয়া রেখেই ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সব টাকা উত্তোলন করে নিয়ে যান তিনি। এরপর শফিকুল ইসলাম জেলার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে সেখানে যোগদান করেন। ভুক্তভোগীরা বিভিন্নভাবে তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি ঘর নির্মাণ করে দেবেন বলে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন। পরে উপজেলার সব ইউপি চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, প্রকল্প পরিচালকসহ বিভিন্ন জায়গায় লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তৎকালীন ইউএনও শফিকুল ইসলাম চেয়ারম্যানদের হুমকি-ধমকি দিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ দিকে প্রকল্প পরিচালক বিষয়টি তদন্তের জন্য জেলা প্রশাসককে দায়িত্ব দেন। জেলা প্রশাসক জেলা পরিষদের সচিবকে দায়িত্ব দিলে তিনি একদিন মাঠে তদন্ত করতে এলে পরের দিন পদোন্নতি পেয়ে লালমনিরহাট চলে যান। এরপর আর কাউকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়নি।
এ দিকে বৃষ্টি আর প্রচণ্ড রোদে অসহায় গরিব মানুষেরা মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় চরম বিপাকে পড়েছেন। গান্দাইল খামারপাড়া গ্রামের শহিদুল ইসলাম জানান, তার নামে ঘর বরাদ্দ থাকলেও তার বাড়িতে ঘর নির্মাণ করা হয়নি। ভুক্তভোগী আশরাফ আলী জানান, ছয় মাস আগে ঘড় তৈরি করার জন্য খুঁটি পুঁতে গেছে, এখনো পর্যন্ত ঘড় তৈরি হয়নি। আরেক ভুক্তভোগী আবুল কাসেম জানান, আট মাস আগে ঘর দেয়ার নাম করে নামমাত্র খুঁটি আর ল্যাট্রিনের সামগ্রী রেখে চলে গেছে। আজ অবধি তাদের আর দেখা মেলেনি।
এ দিকে পাওনা টাকার জন্য স্থানীয় সরকারের উপপরিচালকের কাছে গেলে তিনি দুর্ব্যবহার করে তাড়িয়ে দেন বলে জানালেন কাঠমিস্ত্রি আর কাঠ ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ১৬ লাখ টাকার মধ্যে আট লাখ টাকা দিলেও বাকি টাকা এখনো পাইনি। তা ছাড়া আমার কাছ থেকে কেনা কাঠেরও সন্ধান মিলছে না। আরেক ঘরমিস্ত্রি সোরহাব আলী জানান, কাজের পাওনা ১৫ লাখ টাকা এখনো পাননি। নিজের জমি, বন্ধক রেখে ও গরু বিক্রি করে শ্রমিকদের টাকা পরিশোধ করেছেন। এখন চালানো কষ্টসাধ্য হয়েছে।
কাজিপুর উপজেলার মাইঝবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান শওকত হোসেন জানান, তার ইউনিয়নে ১৭টি ঘর বরাদ্দ থাকলেও পাঁচটি ঘর হয়েছে। দু’টি ঘর নামমাত্র আছে। বাকি ঘরগুলোর কোনো হদিস নেই। তিনি আরো জানান, প্রকল্পে ইউপি চেয়ারম্যানদের সংশ্লিষ্টতা থাকার বিধান থাকলেও সাবেক ইউএনও প্রভাব খাটিয়ে তাদের দূরে রেখেছিলেন। চালতাডাঙ্গা ইউনিয়নের ইউপি চেয়াম্যান আতিকুর রহমান মুকুল জানান, এসব বিষয়ে ইউএনওর কাছে জানতে চাইলে তিনি হুমকি-ধমকি দিতেন। তার ইউনিয়নে ১১টি ঘর বানানোর কথা থাকলেও নি¤œমানের ৯টি ঘর করা হয়। আর বাকিগুলোর শুধু খুঁটি আছে, ঘর নেই।
কাজিপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) এ কে এম শাহ আলম মোল্লা জানান, তিনি সদস্যসচিব কি না তা জানেন না। তবে এ ব্যাপারে তিনি কোনো কথা বলতে পারবেন না। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালকের কার্যালয়ে বারবার গেলেও তার দেখা মেলেনি। এমনকি ০১৭১৮-২৮৮২৪৯ নম্বর মোবাইলে ফোন করলেও সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কথা বলতে রাজি হননি সাবেক ইউএনও ও বর্তমানে জেলা স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক শফিকুল ইসলাম।
সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ফিরোজ মাহমুদ জানান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি চিঠি এসেছে। বিষয়টি তদন্তের জন্য একজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এখন নতুন কাউকে আবার দায়িত্ব দেয়া হবে। তদন্তের পর ব্যবস্থা নেয়া হবে।॥


আরো সংবাদ



premium cement