২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

দুর্যোগ ঝুঁকিতে ভোলার উপকূলে ৫ লাখ মানুষ

আকাশে মেঘ দেখলেই উপকূলের মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রের সন্ধানে ছোটে : নয়া দিগন্ত -

পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার সঙ্কট, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আধুনিক প্রশিক্ষণের অভাব, নির্ধারিত সময়ে ঝড়ের পূর্বাভাস না পাওয়া ও ঝড় মেকাবেলায় প্রস্তুতি নিতে না পারায় প্রতি বছরই দ্বীপজেলা ভোলায় প্রাণহানি ও জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। এতে দুর্যোগ ঝুঁকিতে রয়েছে উপকূলের পাঁচ লাখ মানুষ।
উপকূলের বাসিন্দারা জানান, মেঘনা-তেঁতুলিয়ার কোলঘেঁষা দেশের বৃহৎ দ্বীপটি হচ্ছে ভোলা। প্রায় ১৮ লাখ জনগোষ্ঠীর এ জেলার উপকূলের পাঁচ লাখ মানুষ প্রতি বছরই বর্ষা মওসুমের সময় দুর্যোগ ঝুঁকির মধ্যে থাকেন।
ঝড় জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে পড়লেও জেলায় দুর্যোগ মোকাবেলায় নেয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ। যার ফলে ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। একমাত্র আয়ের উৎস ফসলি জমি, গবাদিপশু আর স্বজনদের হারিয়ে উপকূলের মানুষ আজো ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। আকাশে মেঘ দেখলেই তারা আঁতকে ওঠেন। ঝড়ের কোনো পূর্বাভাস কিংবা বিপদ সঙ্কেত তাদের কাছে পৌঁছে না বলে অভিযোগ তাদের।
ঢালচরের মাহাবুব বলেন, দুর্যোগের সময় প্রায়ই আগাম খবর আমরা পাই না। যার ফলে ঝড়ে পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে পারি না। এ এলাকার অনেক মানুষ নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারে না, শুধু সতর্কবার্তার অভাবে। জেলে আবু কালাম ও সিরাজ বলেন, আকাশে মেঘ দেখলেই বুঝতে পারি ঝড় আসবে। তবে সতর্কবার্তা আমাদের কাছে যথাসময়ে এসে পৌঁছায় না।
উপকূলের বাসিন্দাদের অভিযোগ, দুর্গম চর ও দ্বীপচরের মানুষ ঝড়ের কোনো পূর্বাভাস পায় না। যার ফলে সিডর-আইলায় এখানে বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখানে আশ্রয় কেন্দ্রের সঙ্কট রয়েছে। অনেক চরেই নেই আশ্রয় কেন্দ্র।
মেঘনা উপকূল তুলাতলীর নার্গিস আক্তার বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই আমরা ঝড়ের সঙ্কেত পাই না, তাই সতর্ক হতেও পারি না। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরাই।
ধনিয়া ইউপি চেয়ারম্যান এমদাদ হোসেন কবির বলেন, এ ইউনিয়নটি নদীর কূলে। চারদিকে নদী। এখনে আরো আশ্রয় কেন্দ্র হলে দুর্যোগকালীন সময়ে মানুষ নিরাপদে থাকবে পারবে।
ভোলা সুশীল সমাজের প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট নজরুল হক অনু বলেন, দুর্যোগের সময় দুর্গম এলাকা থেকে মানুষকে ছোট ছোট ইঞ্জিন চালিত নৌকা দিয়ে আনা হয়। এর ফলে তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে উদ্ধারকর্মীসহ সবাই ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। তাই উদ্ধার কাজে শক্তিশালী নৌযান ব্যবহার করলে দুর্গম এলাকার মানুষকে নিরাপদে আনা সম্ভব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির কর্মী, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, জেলা উপজেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্ধারকর্মীরা কাজ করলেও উপকূলের বিশাল এ জনগোষ্ঠীর জন্য রয়েছে মাত্র ৬৬৭টি সাইক্লোন শেল্টার ও ৫২টি মাটির কেল্লা। এসব আশ্রয় কেন্দ্রের অধিকাংই মূল ভূখণ্ডে স্থাপিত হয়েছে। আর দুর্গম এলাকার মানুষের কাছে ঝড়ের পূর্বাভাস পৌঁছায় না। যার ফলে ঝড়ের প্রস্তুতি নিতে পারেন না উপকূলের মানুষ। বিশেষ করে ঢালচর ও চরপাতিলাসহ তজুমদ্দিন ও মনপুরার অনেক চরেই নেই আশ্রয় কেন্দ্র।
এ অবস্থায় আধুনিক প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম ও জনবলসঙ্কটের কথা বললেন দুর্যোগ নিয়ে কাজ করা দুর্যোগ ব্যবস্থা কর্মসূচি ও জেলা রেড ক্রিসেন্টের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থানা কর্মসূচির (সিসিপি) উপপরিচালক সাহাবুদ্দিন মিয়া বলেন, মার্চ-এপ্রিল-মে ও অক্টোবর-নভেম্বর পাঁচ মাস দুর্যোগের মওসুম। তিন মাস গেলেও এখনো দুর্যোগের দুই মাস বাকি রয়েছে।
তিনি বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থানা কর্মসূচির উদ্ধার কর্মী রয়েছেন ১০ হাজার ২০০ জন। যারা দুর্যোগ-পূর্ব, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে কাজ করেন। ইতোমধ্যে যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়েছে তার সবকটিতে তারা কাজ করেছেন। কিন্তু এসব উদ্ধারকর্মীর উন্নত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। এ ছাড়াও দুর্যোগ সময়ে ব্যবহারের জন্য আধুনিক সরঞ্জাম প্রয়োজন।
জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির যুব প্রধান আদিল হোসেন তপু বলেন, দুর্যোগের সময় রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ঝড়ের পূর্বাভাস, সতর্কবার্তা ও উদ্ধারকাজ করে থাকে। কিন্তু নৌ ও সড়কপথে উদ্ধারকাজ করার জন্য আমাদের নিজস্ব নৌ-যান নেই। নেই পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট, হ্যান্ড মাইকসহ আধুনিক কোনো সরঞ্জাম। দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হিসেবে ভোলায় এসব সরঞ্জাম জরুরি। তাই উদ্ধারকর্মীদের প্রশিক্ষণসহ আধুনিক সরঞ্জাম প্রয়োজন।
এদিকে বেসরকারি হিসেবে সিডর, আইলা, কোমেন, রেশমি, ফণি ও মহাসেন ছাড়াও ছোটবড় ২০টি ঝড়ে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে সিডরে ৪২ জন, আইলায় ১৮, ১০ অক্টোবর ২০১২ তে ১৫ ও মহাসেনে চারজনের প্রাণহানি ঘটে।
দ্বীপজেলা ভোলায় দুর্যোগ-পূর্ব, দুর্যোগ সময় ও পরবর্তী সময়ে প্রস্তুতি ও মোকাবেলায় সঠিক পদক্ষেপ আর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে উপকূলের পাঁচ লাখ মানুষ দুর্যোগ মোকাবেলা করে নিরাপদে থাকতে পারবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 


আরো সংবাদ



premium cement