২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চৌগাছার দুটি গ্রামের প্রায় সবাই আর্সেনিকে আক্রান্ত

মারাত্মক আর্সেনিক আক্রান্ত বৃদ্ধ মাহাতাব উদ্দিন ও হাতের আঙ্গুল কেটে বাদ দেয়া রোকেয়া বেগম :নয়া দিগন্ত -

যশোরের চৌগাছা উপজেলার জগদীশপুর ইউনিয়নের মাড়–য়া ও দক্ষিণ সাগর গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই মারণ ব্যাধি আর্সেনিকে আক্রান্ত। গ্রাম দু’টির চার হাজার জনসংখ্যার মধ্যে সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ আর্সেনিকে ভুগছেন। এই জনপদ এখন আর্সেনিক গ্রাম বলেই পরিচিত।
জানা য়ায়, উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী কার্যালয় ও এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্ক (জাপানি একটি সংস্থা) বেশ কিছু গ্রামকে আর্সেনিকযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো চৌগাছাÑ দক্ষিণ সাগর, মাড়–য়া, হায়াতপুর, সিংহঝুলী, জগন্নাথপুর, হাকিমপুর, বেড়গোবিন্দপুর, কুষ্টিয়া, রামভদ্রপুর, ফুলসারা, জগদীশপুর, পাতিবিলা, কয়ারপাড়া, মাজালী, জামিরা, তেঘোরি, গরীবপুর, জাহাঙ্গীরপুর, বলিদাপাড়া ও সুখপুকুরিয়া। জগদীশপুর ইউনিয়ন পরিষদের মাড়–য়া ওয়ার্ডের মেম্বর ইমতিয়াজ আলী বলেন, আর্সেনিকের গ্রাম বললে সবাই মাড়–য়া ও দক্ষিণ সাগরকেই বোঝে। এ দুই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই আর্সেনিকে আক্রান্ত। আমি নিজেও এ রোগে আক্রান্ত।
কথা হয় মাড়–য়া গ্রামের বৃদ্ধ মহাতাপ উদ্দিনের সাথে। তিনি বলেন, আর্সেনিক আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে দারুণ কষ্টে আছি। প্রতি বছর যশোরের ধর্মতলায় সার্জিক্যাল নামে একটি ক্লিনিকে গিয়ে শরীরের গুটি কেটে আসতে হয়। শাহিনুর নামে এক জাপানি ডাক্তার এ অপারেশন করেন। অপারেশনে খরচ হয় ১২-১৪ হাজার টাকা। এ টাকার হাজারে ২০০ করে দিতে হয় আমাদের। বাকি ৮০০ দেয় জাপানি একটি সংস্থা। একই গ্রামের মৃত সবদেল মণ্ডলের ছেলে আলাউদ্দীন জানান, আর্সেনিক আক্রান্ত হয়ে ২০-২৫ বছরে এই গ্রামের প্রায় অর্ধশত লোকের মৃত্যু হয়েছে। রহিমা বেগম বলেন, আমার স্বামী পল্লী চিকিৎসক মিজানুর রহমানের শরীরে ঘা ফুটে গেছে। রোকেয়া বেগমকে আর্সেনিকের কারণে ডান হাতের দু’টি আঙুল কেটে ফেলতে হয়েছে। আর্সেনিকে আক্রন্ত হয়ে আমাদের পরিবারে সাতজন মারা গেছে। শোকাহত রহিমা বেগম ভারী গলায় বলতে থাকেন, ১৯৯০ সালে প্রথম মারা যান তার দেবর আনিছুর রহমান। পরে শ্বশুর ইয়াকুব আলী, স্বামী আলতাফ হোসেন, শাশুড়ি নূরজাহান, স্বামীর ভাই আব্দুল আজিজ, ইউছুফ আলী ও ইউছুফের স্ত্রী সালমা খাতুন। এই গ্রামে আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে আরো যারা মারা গেছেন তারা হলেন আকরাম হোসেন, এলাহি ও ইউনুচ আলী।
মাড়ুয়া গ্রামে গেলে প্রথমেই চোখে পড়ে রঙচঙ করা একটি বাড়ি। চার পাশের ইটের প্রাচীর, দৃষ্টিনন্দন লোহার গেট। বাড়ি দেখলেই বোঝা যায়, পরিবারটি বেশ সচ্ছল। কিন্তু গেটে একটি বড় তালা ঝুলছে। কারণ এই বাড়িতে এখন আর কোনো মানুষ বাস করে না। প্রতিবেশী রাহিমা বেগম জানান, এ বাড়ির অনেকেই আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তাই বাকিরা যশোর শহরে থাকেন। আরো একটি বাড়ি চোখে পড়ে, যার চার পাশে প্রাচীর ও সামনে গেট। বাড়ি দেখলেই বোঝা যায় পরিবারটি সচ্ছল। বাইরের গেটে তালা মারা। একই কারণে এই বাড়িতেও কোনো মানুষ থাকে না। প্রতিবেশীরা জানান, এ বাড়ির মালিক কাশেম আলী আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তার স্ত্রী পদ্মা খাতুন, ২০১৬ সালে ছেলে আয়ুব হোসেন মারা গেছেন। তারা তিনজনই আর্সেনিকে আক্রান্ত ছিলেন। বেঁচে আছেন আয়ুবের স্ত্রী জাহানারা বেগম। আর্সেনিকের ভয়ে তিনি ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার নাটিমা গ্রামে বাবার বাড়িতে থাকেন। কৃষিজমি বর্গা দেয়া। বছরে দু’বার এসে তিনি জমি বর্গার টাকা নিয়ে যান। এ গ্রামের বাজার পাড়ার বিধবা সুকজান বেগম বলেন, আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে আমার ছেলে আজিজুর রহমান, রকিব উদ্দীন, মেয়ে লায়লা খাতুন, যবুনা ও আমি নিজে আর্সেনিকে আক্রান্ত।
এ ব্যাপারে মাড়–য়া বাজারের পল্লী চিকিৎসক বদরুল আলম ও এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্কের সংগঠক লুৎফর রহমান বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতি লিটার পানিতে আর্সেনিকের সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা ০.০১ মিলিগ্রাম; কিন্তু এ দেশে ০.৫ মিলিগ্রাম সহনীয় মাত্রা ধরা হয়। সেখানে আমাদের গ্রামে গড়ে আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে ৮৫ মিলিগ্রাম এবং দক্ষিণপাড়ায় ১০০ মিলিগ্রাম আর্সেনিক পাওয়া গেছে। আর্সেনিকের কারণে আমার ফুসফুসে ক্যান্সার হয়েছে। বেশ কয়েকটি সংস্থা এখানে আর্সেনিক নিয়ে কাজ করছে। তার মধ্যে ২০০১ সালে এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্ক এই গ্রামে বিশেষ গবেষণা শুরু করে। মাটি, পানি, মানুষের রক্ত, মলমূত্রসহ নানা বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়। তারা আর্সেনিকযুক্ত পানির উৎস বন্ধ করার পরিকল্পনা করে। পরবর্তী সময়ে নিরাপদ পানির জন্য পরিশোধক স্থাপন করে। ২০০৮ সালে তাদের প্রকল্প শেষ হয়। তবে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে পরিশোধক থেকে আমরা পানি সংগ্রহ করতে পারছি না। এ ছাড়া পুরো গ্রামে নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য একটি বড় প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল, যার ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৫ কোটি টাকা; কিন্তু ২০১৫ সালে রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যার পর ওই প্রকল্প আর আলোর মুখ দেখেনি।
এ ব্যাপারে মাড়–য়া বাজার মসজিদের মুয়াজ্জিন আনছার আলী বলেন, ২০ বছর ধরে এ রোগে ভুগছি। এখন শ্বাসকষ্ট আর হৃদযন্ত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে। ১০ কাঠা জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করেও সুস্থ হতে পারেনি।
এ ব্যাপারে জগদীশপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তবিবুর রহমান খান বলেন, এ ইউনিয়নের অনেক গ্রামেই আর্সেনিক রয়েছে। তবে মাড়–য়া ও দক্ষিণ সাগর গ্রামের অবস্থা ভয়াবহ।
চৌগাছা উপজেলা জনস্বাস্থ্য অফিসের সহকারী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম বলেন, ২০০৩ সালে এ উপজেলার ৩৬ হাজার নলকূপ পরীক্ষা করে ১৬ হাজার নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া যায়। বর্তমানে জনগণ পানি নিয়ে অফিসে এলে সেটা পরীক্ষা করা হয়।
চলতি অর্থবছরে সরকারিভাবে বিনা মূল্যে ৭৯টি পাতকুয়ার বরাদ্দ এসেছে। প্রতিটি পাতকুয়া নির্মাণ করতে সরকারের ব্যয় হবে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। যাদের নামে বরাদ্দ দেয়া হবে তাদেরকে মাত্র দুই হাজার ৫০০ টাকা ব্যাংক ড্রাফটের মাধ্যমে জমা দিতে হবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: সেলিনা বেগম বলেন, আর্সেনিক রোগীদের হাসপাতাল থেকে সামান্য কিছু ওষুধ দেয়া হয়। তবে সরকারিভাবে সরবরাহ নেই। আক্রান্তদের তালিকা তৈরি করে প্রাথমিক চিকিৎসার পাশাপাশি আর্সেনিকমুক্ত পানি পান করার পরামর্শ দেয়া হয়।
চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মারুফুল আলম বলেন, আর্সেনিকযুক্ত এলাকায় সরকারিভবে বিনা মূল্যে পাতকুয়া দেয়া হচ্ছে। জনগণ সচেতন হলে, নিরাপদ খাবার পানির জন্য টিউবয়েলের ওপর ভরসা করার দরকার নেই। বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে ও ফুটিয়ে পানি ব্যবহার করা যায়।

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল