২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দখলে দূষণে বগুড়ার ১৮ নদী মৃতপ্রায়

বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র দিয়ে প্রবাহিত এই সরু পানির ধারাকে নর্দমার মতো মনে হলেও এটিই এক সময়ের প্রমত্তা করতোয়া নদী :নয়া দিগন্ত -

দখলে দূষণে বগুড়া জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ছোট-বড় ১৮টি নদীর অস্তিত্ব বিলীনের পথে। এসব নদীর বেশির ভাগই স্রোতহীন হয়ে পড়ায় পরিবেশের ওপর পড়েছে বিরূপ প্রভাব। স্থানীয় প্রশাসন নদী রক্ষায় নানামুখী উদ্যোগ নিলেও প্রভাবশালীদের কারণে তা সফল হচ্ছে না। সবচেয়ে করুণ অবস্থা করতোয়া নদীর।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বগুড়া জেলার ওপর দিয়ে ছোট-বড় ১৮টি নদী প্রবাহিত। এর মধ্যে প্রধান প্রধান নদী হচ্ছে যমুনা, বাঙ্গালী, করতোয়া, ইছামতি, হলহলিয়া, নাগর, মানস ও গাংনাই। এসব নদী আজ অস্তিত্ব হারানোর পথে। বগুড়া শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করতোয়া নদী অবৈধ দখল ও দূষণে ময়লার ড্রেনে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে এ নদীর উজানে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার খুলশী নামক স্থানে অপরিকল্পিত জলকপাট নির্মাণের কারণে স্রোত নেই। বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র হয়ে বয়ে যাওয়া প্রমত্তা নদীটি আজ আর নদী নেই। দূরে বা কাছ থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই যে এটি একসময় খরস্রোতা নদী ছিল। দখলে দূষণে নদীটি পরিণত হয়েছে শহুরে ড্রেনে। দখলের সাথে বর্জ্য ফেলায় পরিস্থিতি হয়েছে আরো করুণ। ইচ্ছে মতো দখল দূষণে মরে গেছে নদী। ঢেউ নেই, পানি নেই, পাড় নেই। এসবের বদলে আছে নদীর পাড়ে সুউচ্চ ভবন, দখলদারদের বাড়িঘর, অবৈধ স্থাপনা, শহরের বর্জ্য নদীতে ফেলার সহস্র ড্রেনেজ ব্যবস্থা। নদী বাঁচাতে জেলা প্রশাসন থেকে ৩১ জন দখলদারের তালিকা করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উচ্ছেদ অভিযান না থাকায় দখলদাররা হয়েছে আরো বেপরোয়া।
প্রায় ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ করতোয়া নদীর তীর ঘেঁষে প্রাচীন পুন্ড্রনগরী মহাস্থানগড়ের গোড়াপত্তন হলেও সেই করতোয়া নদী আজ ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিতে চলেছে। নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলার নিচু জলাভূমি থেকে উৎপত্তি করতোয়া নদীর। এই নদী দিনাজপুরের পার্বতীপুর ও নবাবগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে রংপুরের বদরগঞ্জ, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ হয়ে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায় প্রবেশ করেছে। করতোয়া নদী বগুড়া শহরের বুক চিরে প্রবাহিত হয়ে জেলার শেরপুর উপজেলার চান্দাইকোনায় বাঙালি নদীতে মিলেছে। উৎপত্তিস্থল থেকে এর দৈর্ঘ্য ২০০ কিলোমিটার। এরই মধ্যে দখল আর ভরাটের কারণে এটি এখন মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৮৮ সালে বন্যার সময় তৎকালীন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে গাইবান্ধার গোাবিন্দগঞ্জ উপজেলা সদরের খুলশিচাঁদপুর এলাকায় বাঁধ ও স্লুইস গেট নির্মাণের মাধ্যমে করতোয়া নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হয়। সে সময় ওই অংশে করতোয়ার মূল স্রোত একটি শাখা নদীর মাধ্যমে বাঙালি নদীর সাথে যুক্ত করা হয়। এতে গোবিন্দগঞ্জ থেকে ভাটির দিকে অর্থাৎ বগুড়ার দিকে করতোয়া নদীর প্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে দিনে দিনে নদীটি সরু খালে পরিণত হয়। এক দিকে পানিশূন্যতায় প্রবাহ বন্ধ, অন্য দিকে ভরাট আর দখলের কারণে নদীটি এখন মৃত। করতোয়া নদীর শহরের ভেতরের অংশে যে যেখানে পেরেছে দখল ও ভবন নির্মাণ করেছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনেই দখল করে নদীর ভেতরে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। চলছে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ। এই স্থানে নদীর ভেতরে টাঙ্গানো সাইন বোর্ডে লেখা রয়েছে ‘পৈতৃক সূত্রে এই জায়গার মালিক খাজা একরামুল হক ও ডা: খাজা এ জি এম হক। জমির পরিমাণ ২৮ শতাংশ।’ অথচ ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল ১৯৯০-এর ৩৩৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তীরবর্তী কোনো জমির মালিক নদীর তলদেশ দখল করতে পারেন না। ৩৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নদীর দুই ধারে যে অংশে শুষ্ক মওসুমে চর পড়ে কিন্তু বর্ষা মওসুমে ডুবে যায় তা তলদেশ হিসেবে বিবেচিত হয়। এ দিকে শুষ্ক মওসুম আসার আগেই করতোয়া নদী এখন পানিশূন্য। দুই একটি স্থানে পানি দেখা গেলেও শহরের ২০ কিলোমিটারে শুধু ড্রেনের কালো পানি জমে আছে।
দখল করা নদীর তীরে নির্মাণ করা হয়েছে শত শত বাড়িঘর, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও বহুতল ভবন। সুযোগ মতো প্রভাবশালীরা নামে বেনামে নদীর তীর দখল করে নিয়েছে। বগুড়া শহরের এসপি ব্রিজ লেন, ভাটকান্দি, চেলোপাড়া ও ব্রিজ এলাকা, ফুলবাড়ি, মালতীনগরের বেশ কিছু এলাকায় নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ভবন। ভবনগুলোর ড্রেনেজ ব্যবস্থা করা হয়েছে নদীর বুকে। এ ছাড়া বগুড়া পৌরসভার প্রধান প্রধান ড্রেনগুলোও মিলিত হয়েছে করতোয়া নদীতে। শহরের আবর্জনা ও ক্লিনিকের বর্জ্যও ফেলা হচ্ছে।
বগুড়া জেলা প্রশাসনের রাজস্ব শাখা সূত্র জানায়, শহরের ভেতরে করতোয়া নদীর কয়েকটি স্থান দখল হয়েছে। নদীর দখল হয়ে যাওয়া স্থানে বাড়িঘর ও ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দখল হয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ সাড়ে পাঁচ একর। করতোয়া নদী দখলের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে সর্বশেষ ৩১ জন দখলদারের নামের তালিকা তৈরি করা হয়। জেলা প্রশাসন জরিপ দল গঠন করে জরিপ করে ৩১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দাখিল করে। দখলদারদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। তারা প্রায় পাঁচ একর জমি দখল করে রেখেছে। জেলা শহরের সূত্রাপুর এলাকার ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ প্রায় দেড় শতক জমি দখল করে সীমানা প্রাচীর করেছে।
বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আলিমুন রাজিব জানান, ৩১ জন দখলদারের তালিকা তৈরির পর নতুন করে উচ্ছেদ নথি তৈরি করা হচ্ছে। এরপর টিম করে পর্যায়ক্রমে অভিযান চালানো হবে।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ জানান, আইন অনুযায়ী কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভেঙে গেলে সেটা নদীর অংশ। ওই জায়গা কেউ ব্যক্তি মালিকানার দাবি করে ভরাট করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যাবে।
জেলার অন্যতম যমুনা ও বাঙ্গালী নদীও বিলুপ্ত হওয়ার পথে রয়েছে। এসব নদীতে তেমন পানি নেই। শুষ্ক মওসুম আসার আগেই শুকিয়ে গেছে নদীর তলদেশ। আগে এসব নদীর পানি দিয়ে পাশের জমিতে ফসল চাষ হতো। এখন আর পানি নেই। সেই সাথে মাছ নেই। তবে সরকার বাঙ্গালী নদী খননে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে বলে জানা গেছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে নদীর গভীরতা বাড়বে এবং পানির স্রোত ফিরে আসবে।
এ ছাড়া এসব নদী থেকে প্রভাবশালীরা অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে নদী তীর দ্রুত ভেঙে পড়ছে। সেই সাথে নদীর ওপর তৈরি করা ব্রিজগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। এর সাথে জড়িতরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় স্থানীয় প্রশাসন সফল হচ্ছে না।
বগুড়া জেলার ১৮টি নদী রক্ষার দাবিতে প্রথম বারের মতো বগুড়ায় তিন দিনব্যাপী নদী মেলার আয়োজন করেছিল জেলা নদী রক্ষা কমিটি ও নদী বাঁচাও বগুড়া নামে দু’টি সংগঠন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জেলা শাখার সহযোগিতায় শহরের শহীদ খোকন পার্কে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয় ১৪-১৬ ফেব্রয়ারি।


আরো সংবাদ



premium cement