২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ঠাকুরগাঁওয়ের তিন শতাধিক তাঁত অর্থ সঙ্কটে বন্ধ

পুঁজির অভাবে ব্যবসা বাড়াতে পারছেন না ঠাকুরগাঁওয়ের কেশুরবাড়ি গ্রামের তাঁতিরা :নয়া দিগন্ত -

ঠাকুরগাঁওয়ে অর্থ সঙ্কট, জনবলের অভাব, তাঁত শিল্পে ব্যবহৃত জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধিতে বন্ধ হয়ে গেছে তিন শতাধিক তাঁত কারখানা। শীতকালেই মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্তের দরকার মোটা কম্বল আর চাদর। ঠাকুরগাঁওসহ বৃহত্তর দিনাজপুরের দরিদ্র মানুষের মোটা কাপড়ের চহিদা মেটাতে সদর উপজেলার কেশুরবাড়ির তাঁতিরা বিরাট ভূমিকা রাখে। বর্তমান সময়টা গরম কাপড় ও কম্বল বিক্রির উপযুক্ত সময়। কিন্তু অর্থ সঙ্কটসহ নান সমস্যার কারণে ঠাকুরগাঁওয়ের কেশুরবাড়ি গ্রামের ৬০০ তাঁতি পরিবার অভাব-অনটনে জর্জরিত হয়ে পড়েছে।
তাঁতের চাদর ও কম্বল তৈরিতে সুতাসহ নানা উপকরণ লাগে। কিন্তু এবার শীত শেষ হতে চললেও হাতে টাকা পয়সা না থাকায় কম্বল তৈরিতে তেমন বিনিয়োগ করতে পারেননি তাঁতিরা।
কেশুরবাড়ি গ্রামের বৃদ্ধ তাঁতী সুবোধ দেবনাথ বলেন, গত দুই বছর আগে ৫০ হাজার পিস কম্বল বিক্রি করলেও গত বছর কেউ কম্বল কিনতে আসেনি। গ্রামের তাঁতি মহাদেব জানান, কয়েক বছর আগে সরকারি-বেসরকারিভাবে প্রচুর কম্বল বিক্রি হতো। এখন এর চাহিদা দিন দিন কমছে। এ ছাড়া, পর পর দুই বছর বড় ক্রেতার দেখা নেই। এতে বলে তাদের ব্যবসার মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। ইদানিং তৈরি কম্বল-চাদর গ্রামে গঞ্জে ফেরি করে বিক্রি করতে হচ্ছে। তাদের তৈরি কম্বল ১৮০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয়। ৫৫ বছর বয়সী তাঁতি মুধূসুদন বলেন, তিনি সৈয়দপুর হ্যান্ডলুম বোর্ড থেকে ঋণ নিয়ে কম্বল তৈরি করেছেন। কিন্তু বিক্রি নেই। এ রকম হলে ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকবে না।
তাঁতিরা অভিযোগ করেন, এ বছর তাঁতিদের নতুন কোনো ঋণ দেয়া হচ্ছে না। তাঁতি চন্দন কুমার দেবনাথ বলেন, আমরা বাপ-দাদার এই পেশাকে ধরে রাখতে চাই। কম্বল আর চাদর বিক্রিতে সরকারি সহযোগিতা চাই। এতে কাজের ন্যায্য দাম পাওয়া যাবে। কষ্ট করে দিন রাত কাজ করবো। তৈরি চাদর-কম্বল বিক্রি হলে আর কিছু চাই না।
জানা যায়, কেশুরবাড়ি গ্রামের তাঁতশিল্পের আবির্ভাব ২০০ বছর আগের। বর্তমানে তাঁতিদের সংখ্যা বাড়লেও উৎপাদনের গুণগত মান বাড়েনি। তাঁতিরা জানান, দৈনিক পাঁচ হাজার কম্বল-চাদর উৎপাদন সম্ভব। তবে এখানকার তাঁতিরা নিজেদের জীবিকা নির্বাহের সাথে সাথে উত্তরাঞ্চলসহ দেশের হতদরিদ্র নিন্মবিত্ত শ্রেণীর কাপড়ের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। গত ৯ বছর আগেও বিসিক দিনাজপুর অফিস থেকে সুতা এনে কাপড় বোনা হতো। অপর্যাপ্ত কাঁচামাল, প্রতিযোগিতামূলক বাজার, তুলার উচ্চমূল্য, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এখানকার তাঁতীরা সুতা তৈরি করা ছেড়ে দিয়েছে। কোনো উপায়ান্তর না দেখে পেশাকে টিকিয়ে রাখতে তিন বছর বগুড়া, রংপুর, সৈয়দপুর থেকে উলের সুতার এনে মোটা চাদর, কম্বল তৈরি করা হচ্ছে। তাঁত তৈরির জন্য সূক্ষ্ম কোনো যন্ত্রপাতি দরকার পড়ে না। কয়েক টুকরা বাঁশ, কাঠ, লোহা দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। পৃথক কোনো ঘরের দরকার হয়না বারান্দাতেই কাজ চলে। প্রয়োজন পড়লে তাঁতিরা নিজেই তাঁত সারিয়ে নিতে পারে। পরিবারের সদস্যগণ সবাই নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ সবাই তাঁতের কাজ সহজেই করে। তুলা পরিষ্কার, সুতা কাটা, সুতা রঙ করা প্রতিটিই কাজে এদের দক্ষতা থাকলেও পুঁজি সঙ্কট, ব্যাংক ঋণের অভাব, বাজারজাতকরণের এবং পরিকল্পনা ও অনুদানের অভাবে এখানকার তাঁত শিল্প চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তাঁতিরা জানান, তারা এখন পরিবার পরিজন নিয়ে চরম কষ্টের মধ্যে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কারণ হিসেবে তারা উলেখ করেছেন, অর্থ সঙ্কট, ধারদেনা, তাঁত শিল্পে ব্যবহৃত সুতা, রাসায়নিক দ্রব্য, লেবার খরচ আগের চেয়ে অনেক বেশি হওয়ায় অধিকাংশ তাঁতিই বিপদে পড়েছেন। তাঁত শিল্পে ব্যবহৃত জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও তাদের তৈরি বস্ত্রের দাম তুলনামূলকভাবে বাড়েনি। ফলে শত শত তাঁতি এখন জীবন-জীবিকার তাগিদে বাপ-দাদার আদি পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement