২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`
যমুনায় নাব্যতা সঙ্কট

বাঘাবাড়ী বন্দরে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় অর্ধেকে নেমে এসেছে

বাঘাবাড়ী বন্দরের সামনে বড়াল নদীর মধ্যে জেগে ওঠা বিশাল চর :নয়া দিগন্ত -

বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের সামনে বড়াল নদীতে জেগে ওঠা বিশাল চরের পরিধি বাড়ায় দু’টি জাহাজ পাশাপাশি চলতে পাড়ছে না। বাঘাবাড়ী বন্দরমুখী যমুনা নৌপথের নাব্যতা সঙ্কট অব্যাহত রয়েছে। এতে বন্দরে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় অর্ধেকে নেমে এসেছে। বান্ডালিং পদ্ধতি প্রয়োগ করে এই নাব্যতা সঙ্কট ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে যমুনা নদী পাড়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
এ দিকে চলতি বোরো মওসুমে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলাসহ ১৯ জেলায় ৫৫ কোটি লিটার ডিজেলের প্রয়োজন হয়। সেখানে বাঘাবাড়ী অয়েল ডিপোর পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা ৩টি কোম্পানির বিপণন কেন্দ্রে মাত্র ৬ কোটি লিটার ডিজেলের আপদকালীন মজুদ আছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
অভিযোগ উঠেছে, বিআইডব্লিউটিএ নৌ চ্যানেল সচল রাখতে গতানুগতিকভাবে ড্রেজিং করে যাচ্ছে। নাব্যতা বজায় রাখার জন্য তারা কোনো বিকল্প পদ্ধতি প্রয়োগ করছে না। স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিআইডব্লিউটিএর অপরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের কারণে নাব্যতা সঙ্কট অব্যাহত রয়েছে। তারা ড্রেজিং করে পলিমাটি নিরাপদ দূরত্বে না ফেলে নদীতেই ফেলছে। ফলে ড্রেজিং স্পয়েল স্রোতের টানে ভাটিতে গিয়ে জমে আবারো ডুবোচরের সৃষ্টি হচ্ছে।
যমুনা নদী পাড়ের একাধিক সূত্র জানায়, ২০০৩ বাঘাবাড়ী নৌপথে মারাত্মক নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। সে সময় ড্রেজিংয়ের পাশাপাশি যমুনা নদীর দুই পাশে বিভিন্ন পয়েন্টে বাঁশের বাঁধ নির্মাণ (বান্ডালিং পদ্ধতি) করে তাতে তালাই বিছিয়ে নদীর প্রশস্ততা কমিয়ে আনা হয়। প্রশস্ততা কমে যাওয়ায় পানি নদীর মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে পানির প্রবাহ ও স্রোতে গতি বেড়ে যায়। ফলে নদীতে পলি জমতে পারে না। পানির উচ্চতা ও প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় নাব্যতা ফিরে আসে। বর্তমানে ড্রেজিয়ের পাশাপাশি অল্প খরচে বান্ডালিং পদ্ধতি প্রয়োগ করে নদীতে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে সূত্র জানিয়েছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বিপিসির বাঘাবাড়ী রিভারাইন অয়েল ডিপো ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বোরো মওসুমে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও জামালপুর জেলায় সেচের জন্য আট লাখ ৯৬ হাজার ৭৫টি সেচযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ ডিজেল ও ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎনির্ভর। সেচ মওসুমে ডিজেল চালিত ৮২৮টি গভীর নলকূপ, ছয় লাখ ৭৩ হাজার ৮৭০টি অগভীর নলকূপ, ১১ হাজার ৩৭৭টি শক্তিচালিত পাম্পের সাহায্যে সেচ কার্যক্রম চলানো হয়। এর জন্য প্রায় ৫৫ কোটি লিটার ডিজেলের প্রয়োজন হবে। ডিজেল চাহিদার প্রায় ৯০ ভাগ বাঘাবাড়ী অয়েল ডিপো থেকে সরবরাহ করা হয়। উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি তেল সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার না গেলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। সেই সাথে এ অঞ্চলের সেচনির্ভর বোরো আবাদ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে চরম বিপর্যয় নেমে আসবে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই নৌপথ নিয়ে সরকারকে স্নায়ুচাপে থাকতে হয়।
বগুড়া ন্যাশনাল লোড ডিসপ্যাচ সার্কেল (এনএলডিসি) সূত্রে জানা যায়, জ্বালানি তেলনির্ভর বেড়ার ৭১ মেগাওয়াট, বাঘাবাড়ীর ৫০ মেগাওয়াট, রাজশাহীর আমনুরা ৫০ মেগাওয়াটসহ ৫টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে। বিদ্যুৎচালিত সেচপাম্পের রয়েছে প্রায় দুই লাখ ১০ হাজার। এর জন্য বাড়তি বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে প্রায় ৮৪৩ মেগাওয়াট। বর্তমানে রাজশাহী বিভাগে প্রতিদিন ৮৮০ মেগাওয়াট ও রংপুর বিভাগে ৫২৭ মেগাওয়াট লোড ব্যবহার করা হচ্ছে। সেচ মওসুমে রাজশাহী বিভাগে প্রতিদিন এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াট এবং রংপুর বিভাগে ৯৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে।
বিসিআইসির বাঘাবাড়ী ট্রানজিট বাফার গুদাম সূত্রে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ১৪টি বাফার গুদামে রাসায়নিক সার চাহিদার ৯০ ভাগ বাঘাবাড়ী বন্দর থেকে জোগান দেয়া হয়। এখান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার বস্তা রাসায়নিক সার সড়ক পথে বাফার গুদামগুলোতে সরবরাহ করা হয়। যমুনা নদীর নাব্যতা সঙ্কটে বাফারগুদামগুলোতে সারের আপদকালীন মজুদ গড়ে তোলার কাজ চরমভাবে বিঘিœত হচ্ছে। বিসিআইসির বগুড়া আঞ্চলিক অফিসের একটি সূত্র জানান, ইরি-বোরো আবাদ মওসুমে উত্তরাঞ্চলে ১২ লাখ টন রাসায়নিক সার প্রয়োজন হয়। এই সার বিভিন্ন পথে আমদানি করা হচ্ছে। তবে ৯০ ভাগ সার বাঘাবাড়ী বন্দর দিয়ে আমদানি করা হয়। এ দিকে যমুনা নৌরুটে নাব্যতা সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ায় এখন বেশিরভাগ সার নগরবাড়ী বন্দরে আনলোড করে সেখান থেকে সড়ক পথে বাফারগুদামগুলোতে পাঠানো হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার ডিস্ট্রিবিউটর এজেন্ট অ্যান্ড পেট্রল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, আরিচা-বাঘাবাড়ী নৌপথে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় জ্বালানি তেল, রাসায়নিক সারসহ অন্যান্য মালামাল পরিবহনের একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মাধ্যম। এ নৌপথে জ্বালানি তেলবাহী ট্যাংকার, রাসায়নিক সার ও বিভিন্ন পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ চলাচল করে। বাঘাবাড়ী বন্দর থেকে উত্তরাঞ্চলে চাহিদার ৯০ ভাগ জ্বলানি তেল ও রাসায়নিক সার সরবরাহ করা হয়। উত্তরাঞ্চলে পাঁচ শতাধিক পেট্রল পাম্প, তিন শতাধিক ডিলার এবং পাঁচটি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র আছে। এছাড়া প্রায় তিন লক্ষাধিক বাস, ট্রাকসহ ডিজেল চালিত বিভিন্ন ধরনের যানবাহন রয়েছে। অক্টোবর মাসে ১০ লাখ লিটার জ্বালানি তেল নিয়ে জাহাজ বাঘাবাড়ী বন্দরে ভীড়েছে। মধ্য নভেম্বর থেকে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ লিটারে। তিনটি কোম্পানিতে প্রতিদিন রিসিভ হচ্ছে মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ লাখ লিটার জ্বালানি তেল। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী মার্চ মাসের মাঝামাঝি উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি তেল বিশেষ করে ডিজেল সঙ্কট দেখা দিতে পারে। এতে সেচনির্ভর বোরো আবাদ এবং বিদু্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বিআইডব্লিউটিএ আরিচা অফিসের যুগ্ম পরিচালক আব্দুর রহিম জানান, আরিচা-বাঘাবাড়ী নৌপথের কিছু কিছু পয়েন্টে পানির গভীরতা কমে ৬ থেকে ৭ ফুটে দাঁড়িয়েছে। উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি তেল ও রাসায়নিক সার সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য বিআইডব্লিউটিএ ড্রেজিং কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই নৌ চ্যানেল সচল রাখার জন্য বিভিন্ন পয়েন্টে দু’টি ড্রেজার পলি অপসারণ করছে। এ দিকে বালুর প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় ড্রেজিং করার পর ভাটিতে পলি জমে ডুবোচরগুলো আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। বাঘাবাড়ী নৌপথে ৬ থেকে সাড়ে ৬ ফুট ড্রাফটের পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু কার্গোজাহাজগুলো অতিরিক্ত মালামাল বহন করায় ডুবোচরে আটকা পড়ছে।
বিপিসির বাঘাবাড়ী রিভারাইন অয়েল ডিপোর যমুনা কোম্পানির ম্যানেজার এ কে এম জাহিদ সরোয়ার জানান, বাঘাবাড়ীতে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তিনটি তেল কোম্পানির ডিপোতে প্রায় ৬ কোটি লিটার ডিজেল মজুদ আছে। তিনটি কোম্পানিতে গড়ে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ লাখ লিটার জ্বালানি তেল রিসিভ হচ্ছে। সরবরাহ করা হচ্ছে ৩৫ লাখ লিটার। প্রতিদিন একাধিক জাহাজ জ্বালানি তেল নিয়ে বন্দর ডিপোতে ভিড়ছে। নাব্যতা সঙ্কটে জাহাজগুলো ৬ থেকে ৭ লাখ লিটার জ্বালানি তেল নিয়ে বাঘাবাড়ীতে আসছে। তবে চলতি বোরো মওসুমে উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি তেল (ডিজেল) সঙ্কটের কোনো আশঙ্কা নেই বলে তিনি জানিয়েছেন।


আরো সংবাদ



premium cement