২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

উত্তরাঞ্চলের চরে কৃষি বিপ্লব

পাবনার সুজানগরে পদ্মার চরে সবজির বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে হাসি : নয়া দিগন্ত -

উত্তরাঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীর বুকে জেগে ওঠা বালুচরে নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিহীন দরিদ্র কৃষকেরা কৃষি বিপ্লব ঘটিয়েছেন। এক সময় ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা ও যমুনা নদী ছিল তাদের দুঃখের কারণ। এখন সেই নদীর চরে বিভিন্ন ফসল ফলিয়ে অভাব দূর করছেন স্থানীয় কৃষকেরা। অক্লান্ত পরিশ্রমে অসম্ভবকে সম্ভব করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন নদীভাঙনের শিকার হাজার হাজার নিঃস্ব পরিবার। নদীর বুকে জেগে ওঠা চরের পলিযুক্ত বেলে দো-আঁশ মাটিতে ভাগ্য উন্নয়নের স্বপ্নের ফসল বুনে ঘরে তুলে লাভবান হচ্ছেন চরের নিঃস্ব খেটে খাওয়া মানুষ। ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা ও যমুনার অসংখ্য চরের বেলে-দো-আঁশ মাটিতে এখন শাকসবজিসহ নানা ধরনের ফসল ফলছে।
ইরিগেশন সাপোর্ট প্রজেক্ট ফর এশিয়া অ্যান্ড নিয়ার ইস্টের (ইসপান) এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, দেশের প্রধান পাঁচটি নদীতে চরের আয়তন প্রায় এক হাজার ৭২২ দশমিক ৮৯ বর্গকিলোমিটার। যা দেশের মোট জমির এক দশমিক ১৬ শতাংশ। এই পরিমাণ চরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চরভূমি রয়েছে উত্তরাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকায়। ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় চরের পরিমাণ ৯৮৭ দশমিক ৬০ বর্গকিলোমিটার। পদ্মা অববাহিকায় চরভূমি ৫০৮ দশমিক ২৭ বর্গকিলোমিটার। মেঘনার উত্তর ও দক্ষিণ অববাহিকায় চরের পরিমাণ ২২৬ দশমিক ৭৫ বর্গকিলোমিটার। এই চর এলাকায় বাস করছে অন্তত সাত লাখ মানুষ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস করে যমুনা নদীর চর এলাকায়। এ সংখ্যা প্রায় চার লাখ। ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা ও যমুনার বুকে জেগে ওঠা অসংখ্য ছোট-বড় চরে গড়ে উঠছে জনবসতি ও গবাদিপশুর ছোট ও মাঝারি খামার।
ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা ও যমুনার ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে অনেক পরিবার। এমনকি অভাব-অনটন ছিল তাদের নিত্যদিনের সাথী। এখন সে চিত্র বদলে গেছে। নদীর ছোট-বড় অসংখ্য চরে ফলছে গম, কাউন, ভুট্টা, বাদাম, মিষ্টি আলু, তিল, তিসি, পেঁয়াজ, রসুন, লাউ, গাজর, মরিচ, হলুদ, শসা, সিম, কুমড়াসহ নানা প্রকারের শাকসবজি। চরের বেলে দো-আঁশ মাটিতে ডালজাতীয় ফসল মাসকালাই, খেসারি, ছোলা প্রচুর পরিমাণে আবাদ হচ্ছে। এ ছাড়া চরে গড়ে ওঠছে জনবসতি ও গবাদিপশুর ছোট ছোট খামার। চরের কৃষি বিপ্লবের পাশাপাশি গবাদিপশুর খামার গড়ে ওঠায় সম্ভাবনাময় পদ্মা-যমুনার বুকে জেগে ওঠা এসব চর পাল্টে দিতে পারে দেশের অর্থনীতির চিত্র। চরের আকার বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি তা স্থায়ী চরে পরিণত হচ্ছে। জনবসতিহীন দুর্গম এসব চরে এখন বসেছে প্রাণের মেলা।
সিরাজগঞ্জের চৌহালীর স্থল ইউনিয়নের গোসাইবাড়ি চরের শুকুর ব্যাপারী বলেন, তিন বছর আগে সংসারে অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। কর্মসংস্থান ছিল না। বাধ্য হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে যমুনা চরে এসে নতুন বসতি গড়ি। গরু পালন করে এখন স্বাবলম্বী। আল্লাহর রহমতে সংসারে কোনো অভাব-অনটন নেই।
খাষপুখুরিয়া ইউনিয়নের কোদালিয়াচরের ময়নাল সিকদার, রজব আলী, উমরপুরচরের আবু ছাইদ ও কোরবান আলী জানান, চর এলাকায় খোলমেলা পরিবেশে গবাদিপশু পালন করায় রোগবালাই কম হয়। পলি মাটির আস্তরণে জেগে ওঠা ঘাস, বিচালি খাইয়ে তারা গবাদিপশু লালন পালন করছেন। এ জন্য চরে অনেকেই গরু-মহিষ-ছাগলের ছোট ছোট খামার গড়ে তুলছে।
বর্তমানে চরে বসতি স্থাপন করে বসবাস করছে ভূমিহীন মানুষেরা। বাড়ির আঙিনায় মাথা উঁচু করলেই দেখা যায় ফসলের ক্ষেত। চোখ ধাঁধানো বর্ণিল সবুজ ফসলের সরব উপস্থিতির কারণে অনেক কৃষক তাদের গবাদিপশু নিয়ে চরে উপস্থিত হয়েছে। চরের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে একটি করে গো-খামার গড়ে ওঠছে। গোখাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় এই সমস্ত কৃষকেরা তাদের গবাদিপশু নিয়ে এসেছে চরে। পলি মাটির আস্তরণে জেগে ওঠা ঘাস, বিচালি খাইয়ে তারা গবাদিপশু লালনপালন করছে। এক সময় পদ্মা-যমুনা নদীর পানি ও মাছের প্রাচুর্যতা থাকলেও এখন তাতে ভাটা পড়েছে।
তবে চরে বসবাসরত ছেলেমেয়েরা শিক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। তাদের লেখাপড়ার জন্য নেই কোনো স্কুল-মাদরাসা।
চৌহালীর মিনারদিয়ার চরের কৃষক আতাউল জানান, বালুচরে কোনো ফসল ফলানো যাবে এটি স্বপ্নেও ভাবিনি। এখন বালুচরে ফসল আবাদ করে অভাবের সংসারে সচ্ছলতা এসেছে। প্রতি বছরই বাড়ছে চরের পরিধি। সেই সাথে বাড়ছে ফসলের ফলন। লাভের টাকা হাতে পেয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন কৃষকেরা।
ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা ও যমুনার চর থেকে কোরবানির ঈদের আগে প্রচুর গরু বিক্রি হয়। চরে খামারিরা গবাদিপশু পালন করে বেশি লাভবান হচ্ছেন। কারণ গবাদিপশু পুষতে তাদের বেশি খরচ বহন করতে হয় না। চরের জমিতে রোপণ করা ধানের খড় ও নানান ফসল খেয়ে গবাদিপশুগুলো বড় হচ্ছে। এ কারণেই প্রতিনিয়তই চরাঞ্চলে গবাদিপশুর খামারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা ও যমুনা নদীর সম্ভাবনাময় চরের কৃষি ও গবাদিপশুর খামার পাল্টে দিতে পারে দেশের অর্থনীতির চিত্র।


আরো সংবাদ



premium cement