২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্মরণকালের মন্দার কবলে পাবনার তাঁতশিল্প

পাবনার বেড়া উপজেলায় ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকা তাঁতশিল্পের একটি : নয়া দিগন্ত -

স্মরণকালের মন্দার কবলে পড়েছে দেশের তাঁতশিল্প। দেশে-বিদেশে তাঁতবস্ত্রের চাহিদা কমে যাওয়ায় পাবনা অঞ্চলের তাঁত মালিকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। উৎপাদিত তাঁতবস্ত্র বিক্রিতে অব্যাহত লোকসানে মালিকরা তাঁত কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। পুঁজি হারিয়ে অনেকেই পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। হাজার হাজার তাঁতশ্রমিক বেকার হয়ে পরিবারপরিজন নিয়ে কষ্টে জীবন যাপন করছেন।
তাঁত কারখানার মালিকরা বলছেন, এভাবে লোকসান অব্যাহত থাকলে তাঁতশিল্প ও শিল্পের সাথে জড়িতরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদেশে রফতানি এবং দেশে চাহিদা কমে যাওয়ায় তাঁতবস্ত্রের বাজারদর প্রতিদিন নি¤œমুখী হচ্ছে। সরকারিভাবে পদক্ষেপ না নেয়া হলে ভবিষ্যতে এ অবস্থা আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন, এখন সব শ্রেণিপেশার নারী সালোয়ার-কামিজ বেশি ব্যবহার করায় শাড়ির ব্যবহার কমে গেছে। এতেই এ অবস্থা তৈরি হয়েছে।
জানা গেছে, দেশে-বিদেশে তঁাঁতবস্ত্রের চাহিদা কমে যাওয়ায় তাঁতে উৎপাদিত শাড়ি-লুঙ্গির বিক্রি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। উৎপাদিত পণ্য লোকসানে বিক্রি করে তাঁতিরা পুঁজি হারাচ্ছেন। বিশেষ করে প্রান্তিক তাঁতিরা চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছেন। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই তাঁতযন্ত্র বিক্রি করে কেউ পোশাকশিল্পে, কেউবা মাটিকাটা শ্রমিক হিসেবে আবার কেউ রিকশাচালকের কাজ নিয়েছেন। কেউ কেউ পুঁজি হারিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বর্তমানে পাবনা অঞ্চলের প্রায় অর্ধেক তাঁতযন্ত্র বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ঋণগ্রহীতরা তাদের ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না। তাঁত বিক্রি করতে না পেরে অনেকেই তাঁতযন্ত্রের কাঠ জ্বালানি হিসেবে এবং লোহা ভাঙ্গাড়ির দোকানে বিক্রি করছেন।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের পাবনার সাঁথিয়া বেসিকসেন্টার সূত্রে জানা গেছে, পাবনা তাঁতসমৃদ্ধ জেলা হিসেবে পরিচিত। জেলার সাঁথিয়া, সুজানগর ও বেড়া উপজেলায় তাঁতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ২০০৩ সালের তাঁত বোর্ডের জরিপ অনুযায়ী হস্তচালিত তাঁতের সংখ্যা ৫৫ হাজার ও বিদ্যুৎ চালিত পাওয়ারলুমের সংখ্যা প্রায় ২২ হাজার। এই তাঁতশিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে প্রায় দেড় লাখ শিশু ও নারীপুরুষ। এ ছাড়া অন্যান্য ব্যবসায় ও পেশার লোকজন তাঁতশিল্পের উপর নির্ভরশীল। তাঁতশিল্পকে কেন্দ্র করে শাহজাদপুর ও আতাইকুলায় কাপড়ের হাট গড়ে উঠেছে।
স্থানীয় বিভিন্ন প্রাইভেট ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে এবং কাপড় ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আতাইকুলা ও শাহজাদপুর হাটে সপ্তাহের চার দিন দিনরাত মিলিয়ে কাপড় বিক্রি হয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কাপড় ব্যবসায়ী ও দোকান মালিকরা এই হাটে এসে শাড়ি লুঙ্গি কিনে থাকেন। প্রতি হাটে ভারতে শাড়ি ও লুঙ্গি রফতানি হয়ে থাকে। প্রতি হাটে ব্যাংক ও নগদসহ প্রায় ৫০ কোটি টাকার লেনদেন হতো। বর্তমানে কাপড় ক্রয়-বিক্রয়, রফতানি ও ব্যাংক লেনদেন অর্ধেকের কমে নেমে এসেছে। সেই সাথে খেলাপি ঋণের সংখ্যা বাড়ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেড়ার রাকশা গ্রামের কয়েকজন তাঁত মালিক জানান, পুঁজি হারিয়ে তাঁত বিক্রি করে দিয়ে রাতের আঁধারে গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছেন। অনেক দরিদ্র মানুষকে সহায়তা করেছেন। এলাকায় এক সময় প্রচুর দাপট ছিল। এখন নিঃস্ব হয়ে মানসম্মানের ভয়ে বাধ্য হয়ে এলাকা ছেড়েছেন। বেড়ার হাতিড়াগাড়া গ্রামের পাঁচটি কারখানায় প্রায় ২০০ তাঁত বন্ধ রয়েছে। তাঁতি শফিকুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ ৪০ বছরের ব্যবসা জীবনে এমন ভয়াবহ অবস্থা কোনো দিন দেখিনি। কাপড় বিক্রি করে শ্রমিকের মজুরির টাকাই জোগাড় হচ্ছে না। গুদামে লাখ লাখ টাকার কাপড় মজুদ হয়ে আছে। জমি বিক্রি করে বাংকের সুদের ১৬ লাখ টাকা দিয়েছি। মোট ৩০৪ টি তাঁতের মধ্যে মাত্র ৯৫টি তাঁত চালু রেখেছি।
রফতানিকারক মেসার্স রায় ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী নিত্যানন্দ রায় বলেন, শুল্কমুক্ত হওয়ায় তিন বছর আগে ছয়টি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান আতাইকুলা ও শাহজাদপুরের হাট থেকে প্রতি সপ্তাহে চার লাখ পিস শাড়ি ও লুঙ্গি ভারতে রফতানি করত। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে কাপড় রফতানি হতো। তিন বছর ধরে ভারতের রাজ্য সরকার ছয় শতাংশ শুল্ক আরোপ এবং ভারত ও বাংলাদেশে ডলারের মূল্যমানে ব্যবধানের কারণে রফতানির পরিমাণ অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া না হলে এই পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
আতাইকুলা হাটের একাধিক বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপক জানান, গত তিন বছরের অনুপাতে বর্তমানে লেনদেন অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। বেশির ভাগ তাঁত মালিক শুধু লুঙ্গি তৈরি করে থাকেন। অন্য কোনো কাপড় তৈরি করেন না। সে কারণে বাজার মন্দা হওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে। উৎপাদিত কাপড় কম মূল্যে, বাকিতে এবং চেকের মাধ্যমে বিক্রি করায় ব্যাংকে টাকা জমা দিতে পারছেন না। সে কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।


আরো সংবাদ



premium cement