২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
সাগরে বৈরী আবহাওয়া

কুয়াকাটায় বিপাকে ট্রলার মালিকসহ ৫০ হাজার পরিবার

পটুয়াখালীর মহিপুর-আলীপুর শিববাড়ীয়া নদীতে সাগরে বৈরী আবহাওয়ার কারণে এভাবে শত শত ট্রলার আশ্রয় নিয়েছে :নয়া দিগন্ত -

স্রোতের চাপ বেশি। দুই-তিনদিন পর পর সিগন্যাল। সাগর উত্তাল। ঘন ঘন নিম্নচাপ। নৌকা চালানোর উপায় নেই। গেল দেড় মাসে অন্তত ২০ বার আবহাওয়া খারাপ হয়েছে। এমন কথা বললেন ট্রলার মাঝি কাঞ্চন গাজী। গত ২০ বছরে এমন বাজে অবস্থা তিনি আর দেখেননি। নিজের নম্বরবিহীন একটি ফিশিং বোট নিজেই চালান তিনি। একই কথা জেলে ফেরদাউছ আকনের। জানালেন, এমনিতেই এখন ইলিশ পাওয়া যায় অনেক গভীর সাগরে। চরম ঝুঁকি নিয়ে সাগরে যাওয়ার দুইদিন পরেই আবহাওয়া খারাপ হয়ে যায়। কিছু ইলিশ নিয়ে ফিরে আসতে হয়, কখনো খালি হাতে। এক-দুইবার জাল পাতার সুযোগ মেলে। অথচ একেকবারে সাগরে যেতে ৫০-৬০ হাজার টাকা থেকে দেড় লাখ টাকার বাজার করতে হয়। বরফ, খাবার ও জ্বালানিসহ এই খরচ লাগে।
৮-১০ দিন সাগরে থাকলে যে পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যেত তাতে লোকসান হতো না। এফবি হাফসা বোটে এখন বাবুর্চির কাজ করেন মামুন। বয়োবৃদ্ধ মানুষটি জানালেন, অনেক বছর থেকে বোটে কাজ করেন। ১৬-১৭ বছর বয়সে শুরু। টানা ১৯টি বছর মাঝি ছিলেন। মৌডুবির এক মালিকের বোটে এখন আছেন। স্মৃতি থেকে জানালেন, তখন বরফ ছিল না। কাটারুর কাছে ইলিশ বিক্রি করতেন। লবন দিয়ে সংরক্ষণ করতেন। তখনো ৫০-৬০ মন ইলিশ পেতেন একবারে। অনেক কিনারে মাছ ধরতেন। এখন গহিন সাগরে যেতে হয়। ঝড়-ঝাপটাসহ ডাকাতের কবলে পড়েছেন। সাগরে ভেসেছেন। মামুন বললেন, ‘র্যাবের কারণে ডাকাইত নেই বললেই চলে। ভয় কাইট্যা গেছে। কিন্তু সাগর যেন ক্যামন অইয়া গ্যাছে।’ জানালেন, গত এক মাসে অন্তত আটটি বোট ডুবেছে। এখনো সাত জেলে নিখোঁজ রয়েছে। হাজারো ফিশিং ট্রলার শিববাড়িয়ার চ্যানেলের আলীপুর-মহিপুর বন্দরে লাগিয়ে আছে। সবার ভাষ্য এক। মাছ আছে, ধরতে পারছেন না। অন্তত ৩০ হাজার জেলে, ২০০ আড়তমালিক, অর্ধশত বরফকল মালিকসহ ৫০ হাজার পরিবারে এখন শঙ্কা বিরাজ করছে লোকসানের। এ সময় গেল বছর প্রত্যেক ট্রলারের গড়ে লাখ টাকার ব্যবসা হয়েছে। এ বছর তারা বেশির ভাগই লাভের মুখ দেখতে পারেননি। উল্টো লোকসানের ধকল বইছেন। ফেরদাউছ আকন জানালেন, যদিও মাল্লারা বেতনভোগী। তারপরও মনে শান্তি নেই। মালিকের লাভ না থাকলে কারো মন-মেজাজ ভালো থাকে না।
মহিপুর মৎস্যআড়ত ও ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গাজী ফজলুর রহমান জানালেন, ধার-দেনায় কাহিল বেশির ভাগ বোট মালিক। ১০-১২ দিনের বাজার নিয়ে সাগরে গিয়ে গুই দিনও থাকতে পারেন না জেলেরা। এমন কোনো গোন (জো) নেই একবারে দুইদিনের বেশি সাগরে অবস্থান করতে পারছেন। তার দাবি, এমনিতেই এ বছর ইলিশ কম ধরা পড়ছে, তার ওপরে এত বেশি সাগর উত্তাল আগে কখনো দেখেননি। তার মতে একেকটি আড়ত কমপক্ষে ১০ থেকে ৫০ লাখ টাকার দেনায় পড়েছে। গেল বছর এমন সময় আড়তে ছিল ইলিশ আর ইলিশ। আর এ বছর নেই কোনো বেচাকেনার প্রাণচাঞ্চল্য। দৈনিক দুইটি ট্রাকও ফুললোড দিয়ে মোকামে পাঠাতে পারছেন না। শিববাড়িয়া নদীর দুই পাড়ে আলীপুর ও মহিপুর ও কুয়াকাটার মোকামে অন্তত ৮০টি আড়ত রয়েছে। কিন্তু ইলিশের ভরা মওসুমে নেই মাছের আমদানি। সবার ভাষ্য, আবহাওয়া খুব খারাপ। ঘন ঘন নিম্নচাপ। প্রচণ্ড উত্তাল থাকছে সাগর। ৩৫-৪০টি বরফকলেও নেই তেমন বেচাকেনা। শ্রমিকেরাও বেকার। জ্বালানিসহ জেলেদের সাথে সম্পর্কিত দোকানগুলোয় নেই বেচাকেনা। এক কথায় দক্ষিণের অন্যতম ইলিশের মোকাম মহিপুর-আলীপুরে বিরাজ করছে এক ধরনের হতাশা। আড়তমালিক ও হাজার হাজার জেলে পরিবারে চরম উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। সবাই একই কথা, সাগর খুব বেশি গরম। এমনটা তারা গত ২০ বছরে দেখেননি। পেশায় এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
কলাপাড়া উপজেলা ঘুর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) সহকারী পরিচালক আসাদুজ্জামান খান জানান, সাগরে প্রচণ্ড ঢেউ থাকছে এ বছর খুব বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এটি হচ্ছে। আর সাগরে ট্রলারডুবিতে প্রাণহানি এড়াতে বারবার সতর্ক সঙ্কেত দেয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে জেলে, ট্রলার মালিক, আতদারসহ এ পেশাসংশ্লিষ্ট হাজার হাজার পরিবারে লোকসানের শঙ্কা বিরাজ করছে। জেলেসহ সবার দাবি, ইলিশ ধরার আসন্ন নিষেধাজ্ঞার সময়কাল পেছানো হোক।

 


আরো সংবাদ



premium cement