২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

টোকিও অলিম্পিক ২০২০ : বিশ্বকে প্রযুক্তির ম্যাজিক দেখাবে জাপান

-

ঘড়ির কাটায় হিসাব চলছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসর অলিম্পিকের। গেল নভেম্বরেই সকল প্রস্তুতি শেষ করে বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে প্রযুক্তির দেশ জাপান। এখন ক্ষণগণনা। শুধু প্রস্তুতি শেষ করেছে বললে ভুল হবে। কারণ অলিম্পিক উপলক্ষ্যে টোকিও শহরসহ ছোট-বড় সকল শহরকে সাজানো হয়েছে নতুন করে। এমনিতেই সবকিছু সাজানো-গোছানো চমৎকার দেশ! তার ওপর আবার বর্নিল সাজ! যা লিখে বা ছবি তুলে দেখানো বা বুঝানো সম্ভব নয়।

সর্বশেষ আজ রোববার সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণে জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে উন্মুক্ত করা হলো টোকিও নিউ ন্যাশনাল স্টেডিয়াম। সব অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যাবহার করে নির্মাণ করা এ স্টেডিয়ামেই অলিম্পিক আসরের উদ্ধোধনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। ৬০ হাজার সাধারণ আসনসহ সবমিলিয়ে ৬৮ হাজার লোকের ধারণক্ষমতা রয়েছে স্টেডিয়ামটির। এতে ব্যবহার করা হয়েছে হাইব্রিড ব্রডকাস্ট সিস্টেম, সর্বশেষ আবহাওয়া নিয়ন্ত্রক প্রযুক্তি, সংবেদনশীল উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন এইট কে এইচডি ক্যামেরা। শুধু তাই নয় বিরূপ আবহাওয়ায় পাল্টে

যাবে স্টেডিয়ামের দৃশ্যপটও! এছাড়া খেলোয়ার ও অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর জন্য টোকিও শহরের পাশে বিশাল এলাকা নিয়ে সমুদ্র ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন আবাসিক অলিম্পিক ভিলেজ। কি নেই সেখানে! এক পাশে বিশাল সমুদ্র আর আশপাশে সব নামকরা হোটেল-মোটেল এবং পার্ক-বিনোদন কেন্দ্রে ভরপুর! এর পাশেই তৈরী করা হয়েছে মিডিয়ার জন্য অত্যাধুনিক সকল সুবিধা সমৃদ্ধ টোকিও বিগ সাইট এন্ড নাইট

ইন্টারন্যাশনাল ব্রডকাস্ট সেন্টার।সেখান থেকেই ব্রডকাস্ট হবে সারা বিশ্বে। আগামী ২৪ জুলাই উদ্বোধন করা হবে। চলবে ৭ আগস্ট পর্যন্ত। এছাড়া টোকিও প্যারা অলিম্পিক ২৫ আগস্ট থেকে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে।

কোটি কোটি ক্রীড়াপ্রেমীদের অবাক করে দিতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসর অলিম্পিক গেমস দ্বিতীয় বারের মতো আয়োজন করতে যাচ্ছে জাপান। এশিয়া মহাদেশের প্রথম ও একমাত্র দেশ এটি। ১৯৬৪ সালের পর প্রযুক্তির দেশ বলে খ্যাত জাপানে ২০২০ সালে কেমন হবে এ অলিম্পিক? এটা কি কেউ ধারণা করতে পারবে? না, আসলেই কেউ ধারণা করতে পারবে না!

সমুদ্রের ঠিক মাঝখানে পাহাড়-পর্বতে ঘেরা অপরূপ এই দেশটাই যেন একটা গোছানো বাগান। এমন একটি দেশে অলিম্পিক হওয়া মানেই বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়া। সব প্রস্তুত। স্টেডিয়াম থেকে শুরু করে হোটেল-মোটেল, খেলোয়ার-কর্মকর্তাদের আবাসিক বিলাসবহুল অলিম্পিক ভিলেজ, রাস্তা-ঘাট, ট্রেন-বাস স্টেশন, পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো আবার নতুন করে সাঝানো হয়েছে। শপিং সেন্টার, পার্ক-বিনোদনকেন্দ্র বা স্টেশনগুলোর ভেতরে বাইরেও একটু-আধটু করে হাত বুলিয়ে নিচ্ছে। সারা বিশ্বের মানুষকে আমন্ত্রণ জানিয়ে লজ্জিত হওয়ার মতো জাতি যে জাপান নয়। তাই হয়ত বাড়তি সতর্কতা। বাড়তি শ্রম আর বাড়তি অর্থ খরচ করছে জাপান সরকার। সাধারণ মানুষও সচেতন কম নয়। নির্দিষ্ট জায়গা ব্যাতিত কোথাও একটি কাগজের টুকরোও ফেলে না জাপানিরা। থুথু আসলেও টিস্যু পেপার ব্যবহার করে পকেটে রাখে। তাদের সততা, ভদ্রতা, শ্রদ্ধা, সহযোগিতা আর পরিশ্রমের কথা লিখেও যেন শেষ করা যাবে না! অবাক করা বিষয় হলো বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ শহর টোকিও আবার বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহরও এটি। দেশি-বিদেশী মিলে প্রায় আড়াই কোটি মানুষের বাস। এতো মানুষের বসবাস তারপরও শৃঙ্খলা আর নিরাপত্তার বিন্দুমাত্র কোথাও ঘাটতি নেই।

ইতোমধ্যে জাপানের জাতীয় স্টেডিয়ামসহ বেশ কয়েকটি স্টেডিয়াম নতুন করে পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। স্টেডিয়ামগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে টোকিও জাতীয় স্টেডিয়াম র্নিমাণে। প্রায় দেড় বিলিয়ন ইউএস ডলার। সম্পুর্ণ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর এ স্টেডিয়ামটিতে একসাথে বেশ কয়েকটি খেলা উপভোগ করতে পারবে দর্শকরা। স্টেডিয়ামের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারা দর্শকদের জন্য বাইরে থাকবে অত্যাধুনিক এইচডি কোয়ালিটির অসংখ্য এলইডি পর্দা।

0000000

অলিম্পিকের চিত্র ধারণেও থাকবে বিশ্বের সবচেয়ে লেটেস্ট মডেলের ক্যামেরা। জাপানি প্রযুক্তির ৩২ থেকে ৪০ মেগাপিক্সেল পর্যন্ত হবে এসবের ক্ষমতা।

জাপান অলিম্পিক কমিটির তথ্যানুযায়ী, ২০৬টি দেশের ৩২৪টি ইভেন্টে ১২ হাজারের বেশি খেলোয়ার অংশগ্রহণ করবে। ২০২০ সালের ২৪ জুলাই অলিম্পিকের উদ্ধোধনী অনুষ্ঠান টোকিও জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে। জনপ্রিয় ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হবে জাপানের ৭টি বড় স্টেডিয়ামে। এর মধ্যে রয়েছে টোকিও জাতীয় স্টেডিয়াম, ইউকোহামা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম, সাইতামা স্টেডিয়াম, মিয়াগি স্টেডিয়াম, টোকিও আজিনোমতো স্টেডিয়াম, ইবারাকির কাসিমা সক্কার স্টেডিয়াম ও সাপ্পোরো ডমে স্টেডিয়াম।

জাপান অলিম্পিক কমিটি জানায়, টোকিও সিটি গভর্নমেন্ট অলিম্পিক আয়োজনে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ইয়েন অর্থ খরচ করছে। তবে বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে স্টেডিয়াম নির্মাণ, টোকিও’র প্রাণকেন্দ্র ওদায়বায় সাগর পাড়ে বিলাসবহুল অলিম্পিক ভিলেজ নির্মাণ, আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরগুলোর ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি, জাপানের রেলওয়ে সংস্কার, স্টেশনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি, বড় বড় হাইওয়ে রোড সংস্কারসহ সিটি এলাকার বিভিন্ন উন্নয়ন, বর্ধিতকরণ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে ব্যয়

হয়েছে। আয়োজক সংস্থা জানায়, টোকিও ও এর আশপাশের সিটিগুলোতেই অধিকাংশ ইভেন্ট করার প্রস্তুতি শেষ করেছে জাপান। এখন চলছে অপেক্ষার পালা। টোকিও সিটির গভর্ণর ইউরেকো কেইকে জানিয়েছে সব কিছু প্রস্তুত। এখন শুধু অপেক্ষা।

সাগর পাড়ে বিলাসবহুল অলিম্পিক ভিলেজ: সত্যি অসাধারণ এক লোকেশনে তৈরী হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বিলাসবহুল অলিম্পিক ভিলেজ। সাগরের পাড় কিছুটা ভরাট করে বিশাল জায়গা নিয়ে টোকিও সিটির সবচেয়ে দর্শনীয় ও আন্তর্জাতিক হোটেল-মোটেল সমৃদ্ধ স্থান ওদায়বার হারুমি চো-কো’তে গড়ে তোলা হচ্ছে অত্যাধুনিক বিলাসবহুল এ অলিম্পিক ভিলেজ। খেলোয়ার-কর্মকর্তারা থাকবে এখানে।পাঁচতারকা হোটেলের সব সুবিধা রয়েছে খেলোয়ারদের আবাসিক এ ভিলেজে।

বিশালাকৃতির এসব রেসিডেন্সিয়াল বিল্ডিংয়ে প্রায় ৭ হাজারের অধিক ইউনিট রয়েছে। এ ভিলেজ এর পাশেই রয়েছে অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত হারুমিফোতো পার্ক ও সমুদ্র সৈকত। যেসব প্রযুক্তি থাকছে অলিম্পিকে: জাপানের এ অলিম্পিকের অর্থনৈতিক মূল্য তিন ট্রিলিয়ন ইয়েন এর বেশি। টোকিও অলিম্পিকের প্রযুক্তির চমকের মধ্যে রয়েছ এইট কে। টোকিও ২০২০ অলিম্পিকের সবচেয়ে বড় চমক হচ্ছে এইট কে প্রযুক্তি। ২০২০ অলিম্পিকে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। সম্পূর্ণ এইচডি কোয়ালিটি ভিডিও দেখতে পাবেন। এখানে হাইব্রিড ব্রডকাস্ট সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছে। আপনি ফেইসবুক বা টুইটারে সরাসরি কমেন্টস ও টুইট করতে পারবেন। বিগ সাইট ইন্টারন্যাশনাল ব্রডকাস্ট সেন্টার থেকে সারা পৃথিবীতে এ খেলা সম্প্রচারের আয়োজন করা হচ্ছে। বিশালাকৃতির এ ভবনটি গণমাধ্যমের জন্য প্রস্তুত

করা হয়েছে। এতে থাকছে অত্যাধুনিক ব্রডকাস্ট সিস্টেম।যার মাধ্যমে নিমিশেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। এছাড়া প্রতিটি খেলার স্কোর ও বিস্তারিত তথ্য স্পষ্টভাবে স্ক্রিনে দেখতে পাবেন। প্রতিটি ইভেন্টেই সর্বনিন্ম ৩২ মেগাপিক্সেল ক্ষমতা সম্পন্ন ক্যামেরা ব্যবহার করা হবে। আর ক্যামেরাটি অনেক বেশি সংবেদনশীল। এবং সাধারণ ক্যামেরা থেকে এসব ১৬ গুণ প্রখর হবে। এছাড়া সাইন- ল্যাংগুয়েজ নামে নতুন প্রযুক্তি থাকছে যাতে বোবাদের জন্য রয়েছে স্বয়ংক্রিয় সাইন-ল্যাংগুয়েজ। থাকছে ইনস্ট্যান্ট ট্রান্সলেট সিস্টেম। স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাৎক্ষণিক অনুবাদ করতে পারে এমন ডিভাইস ব্যবহার করা হচ্ছে। আরো থাকছে উন্নত মানের মানি ট্রান্সফার সিস্টেম। এসব ছাড়াও প্রতিটি খেলার স্পট ও স্টেডিয়ামে ব্যবহার করা হচ্ছে অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি। যা দেখে পুরো বিশ্ব সত্যি চমকে যাবে।

টোকিও অলিম্পিকে নতুন পাঁচ ইভেন্ট: রিও অলিম্পিকের পর জাপানের অলিম্পিক আসরে নতুন করে আরও পাঁচটি ইভেন্ট যোগ করা হয়েছে। নতুন এ ইভেন্টগুলোতে থাকছে বেসবল, কারাতে, স্কেটবোর্ড, স্পোর্টস ক্লাইম্বিং ও সার্ফিং। মুসলিমদের জন্য থাকছে ভ্রাম্যমাণ মসজিদ: অলিম্পিক আয়োজনকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মুসলিম খেলোয়াড় ও দর্শকদের জন্য টোকিওর বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ মোবাইল মসজিদ তৈরী করা হয়েছে। এছাড়াও ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রেল ও বাস স্টেশনগুলোতেও মসজিদ বা প্রেয়ার রোম খোলা হয়েছে। টোকিও সিটির বেশকিছু বড় স্টেশন ও বিমানবন্দরগুলোতে স্থায়ী প্রেয়ার রোম বা নামাজের জন্য মসজিদ চালু করেছে জাপান সরকার। এছাড়াও মুসলমানদের জন্য টোকিও’র বিভিন্ন স্থানে রয়েছে হালাল খাবারের সুন্দর ব্যবস্থা। রয়েছে হালাল সপ ও হালাল রেস্টুরেন্ট।জাপানের দৈনিক ইউমিউরি শিনবুন-এর বরাত

দিয়ে বার্তা সংস্থা ইকনা বলছে, ভ্রাম্যমাণ মসজিদগুলোকে বিভিন্ন স্টেডিয়াম ও প্রাকটিস ক্যাম্পগুলোর পাশে রাখা হবে, যাতে মুসলিম খেলোয়াড় ও দর্শকরা সহজেই নামায আদায় করতে পারেন। স্থানান্তরের সুবিধার জন্য মসজিদগুলো বড় সাইজের ট্রলির উপর তৈরী করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, দ্বিতীয়বারের মতো এশিয়ার প্রথম কোনো দেশ হিসেবে অলিম্পিকের আয়োজক রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে জাপান। তুরস্কের ইস্তাম্বুলকে হারিয়ে ২০২০ সালের অলিম্পিকের আয়োজক হওয়ার সম্মান অর্জন করে টোকিও। ২০২০ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসরটি বসবে সূর্যোদয়ের দেশ জাপানে।

 


আরো সংবাদ



premium cement