২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ডা: রাজনের মৃত্যু : স্ত্রী বললেন ‘হায় এমন কেন হলো, এমন কেন হলো?’

স্ত্রীর সাথে ডা. রাজন - সংগৃহীত

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা: রাজন কর্মকারের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেছেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ। গতকাল ডা: রাজনের পোস্টমর্টেম শেষে এ তথ্য জানিয়েছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা: উত্তম কুমার বড়ুয়া। তিনি বলেন, ডা: রাজনের পোস্টমর্টেম আমাদের এখানে সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের ফরেনসিক বিভাগ তার পোস্টমর্টেম করেছে। তার শরীরের বাইরে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। কোনো পয়জনের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে কি না, সেটা ভিসেরা রিপোর্ট পেলে জানা যাবে। 

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা: সেলিম রেজা সাংবাদিকদের বলেন, আমরা ডা: রাজনের পোস্টমর্টেম সম্পন্ন করেছি। প্রাথমিকভাবে তার মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি। আমরা তার হার্ট এবং ফরেনসিক নমুনা সংগ্রহ করেছি। এগুলো ল্যাবে টেস্ট করানোর জন্য পাঠানো হয়েছে। এগুলোর ভিসেরা রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে। 

গত শনিবার রাতে বিএসএমএমইউর সহকারী অধ্যাপক ডা: রাজন কর্মকার মারা যান। তার পরিবার, স্বজন, বন্ধু ও সহকর্মীদের অভিযোগ এটি কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। ওই দিন ভোররাত সাড়ে ৩টায় ইন্দিরা রোডের বাসা থেকে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ডা: রাজন খাদ্যমন্ত্রী সাধন কুমার মজুমদারের জামাতা। তার স্ত্রী কৃষ্ণা মজুমদারও একই হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। 

নিহত চিকিৎসক রাজনের বাড়ি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার এখলাছপুর গ্রামে। তিনি ওই এলাকায় সুনিল কর্মকারের ছেলে। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডেন্টাল সার্জারিতে পড়ালেখা শেষ করে তিনি পিজি হাসপাতালে কর্মজীবন শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি গ্রিন রোডের গ্রিন লাইফ হাসপাতালেও চাকরি করতেন। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারে মেয়ে কৃষ্ণা মজুমদারের সাথে তার বিয়ে হয়। এরপর থেকে স্ত্রীকে নিয়ে রাজন ইন্দিরা রোডের ৪৭ নম্বর বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। রাজনের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার রাতে গ্রিন লাইফ হাসপাতালে একটি অপারেশন শেষ করে তিনি রাত সাড়ে ১২টায় বাসায় যান। 

এ ঘটনায় নিহতের মামা সুজন কর্মকার রাজনকে নির্যাতনের অভিযোগ এনে শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেছেন কৃষ্ণা মজুমদারের সাথে বিয়ে হওয়ার পর থেকে তার ভাগিনা শারীরিকভাবে বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছিল। গত শনিবার রাতে তিনি তার বোনের কাছ থেকে জানতে পারেন তার ভাগিনা মারা গেছে। পরে তিনি রাজনের ইন্দিরা রোডের বাসায় যান। বাসার নিরাপত্তাকর্মীর কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন রাত সাড়ে ৩টার দিকে কৃষ্ণা তার স্বামী রাজনকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ বের হয়ে গেছেন। পরে স্কয়ার হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেছেন। এজাহারে তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, তার ভাগিনার মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। 

এ দিকে রাজন কর্মকারের মৃত্যুতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তার সহকর্মী ও বন্ধুরা। তারা রাজনের এই মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। তারা বলেছেন তারা কাউকে দোষী সাব্যস্ত করছেন না। তবে যদি তাকে হত্যা করা হয় ও এই ঘটনার সাথে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে। গত রোববার স্কয়ার হাসপাতালে ডা: রাজনের সহকর্মীদের অনেকেই তার লাশ কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাদের একজন জানিয়েছেন, ডা: রাজনের হাতের বাম দিকে কিছু পুরনো চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে এগুলো অনেক পুরনো। 

জানা গেছে, ডা: রাজন গত রোববার রাত ১টায় বাসায় প্রবেশ করেন। এর ১৫/২০ মিনিট পর আবার বাইরে বের হয়ে আসেন। আবার আধা ঘণ্টা পর বাসায় প্রবেশ করেন। এ সময় বাসায় আর কেউ ছিলেন না। এর আরো অনেকক্ষণ পর তার স্ত্রী ডা: কৃষ্ণা রানী মজুমদার রূপা বাসায় আসেন। রাত সাড়ে ৩টায় তিনি তার গাড়ির ড্রাইভারকে ডেকে লিফট ওপেন করে দারোয়ানদের নিয়ে উপরে আসতে বলেন। দারোয়ানসহ ড্রাইভার বাসায় এলে তারা ডা: রাজনকে ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখেন। এ সময় ডা: কৃষ্ণা মজুমদারকে চিৎকার করতে শোনা যায়। তিনি বলছিলেন, ‘হায় এমন কেন হলো, এমন কেন হলো?’ তারপর ড্রাইভার ও দারোয়ানদের নিয়ে ডা: রাজনকে নিচে নামিয়ে হাসপাতালের দিকে যান; কিন্তু স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডা: রাজনের সাথে তার স্ত্রী ডা: কৃষ্ণা মজুমদার ছিলেন না। তার যমজ বোন হাসপাতালে নিয়ে যান বলে ডা: রাজনের সহকর্মীরা জানিয়েছেন। কেন কৃষ্ণা মজুমদার স্বামীর সাথে আসেননি তা সবাইকে বিস্মিত করে। 

ডা: রাজনের সহকর্মীরা জানিয়েছেন, রাজন একজন প্রমিন্যান্ট সার্জন ছিলেন। তার কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না। সার্জারি ও শিক্ষতাই ছিল তার ধ্যান ও জ্ঞান। অন্য কোনো দিকে তার কোনো মনোযোগই ছিল না। ডিপার্টমেন্টে যতক্ষণ থাকতেন মনোযোগ সহকারে তিনি তার কাজ করতেন। রোগীর সেবায় তিনি অত্যন্ত যতœবান ছিলেন।

লাশ দেখে শোকাবহ পরিবেশ : এ দিকে ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেশিয়াল সার্জন ডা: রাজন কর্মকারের লাশ গতকাল সোমবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আনা হলে শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ডেন্টাল অনুষদের ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেশিয়াল বিভাগের সহকর্মীসহ অন্যান্য বিভাগের পরিচিত চিকিৎসকদের ও কর্মকর্তাদের চোখ পানিতে ছলছল করে ওঠে। এত দিনকার প্রিয় সহমকর্মীর অকাল বিদায়টা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল তাদের। ডা: রাজনের সহকর্মী চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তার মতো ভদ্র, মার্জিত রুচির মানুষ এ সমাজে খুব বেশি চোখে পড়ে না। তার চেহারার মধ্যেই ছিল ভদ্রতার ছাপ। 

ডা: রাজনের লাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলন হলে এনে রাখা হলে তাতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ডা: কনক কান্তি বড়–য়া। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসিত্রয় অধ্যাপক ডা: মো: শহীদুল্লাহ সিকদার, অধ্যাপক ডা: সাহানা আখতার রহমান, অধ্যাপক ডা: মুহাম্মদ রফিকুল আলম, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা: মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা: এ বি এম আব্দুল হান্নান, প্রক্টর অধ্যাপক ডা: সৈয়দ মোজাফফর আহমেদ, নবনিযুক্ত পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে মাহবুবুল হক, ডিন, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স, মেডিক্যাল টেকনোলজি ও কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন।


আরো সংবাদ



premium cement