২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মিন্দানাও : শিক্ষাদানও যেখানে অপরাধ!

স্কুলে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন নেরহায়া ট্যালেডো - ছবি : সংগ্রহ

ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলীয় মিন্দানাওয়ের সিতিও ডুলিয়ান শহরে স্থানীয় শিক্ষিকা নেরহায়া ট্যালেডো যাচ্ছিলেন চাল, মাছ ও নুডুলসের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে। জরুরি কিছু ওষুধপত্রসহ তার পাশে আরেকটি ট্রাকে যাচ্ছিল ডাক্তার ও স্বেচ্ছাসেবকদের একটি দল। কিন্তু তাদেরকে আটকে দেয়া হলো সদ্য তৈরি করা একটি সামরিক চেকপোস্টে। সেখানকার সৈন্যরা জানায়, কোনোভাবেই তাদের ডুলিয়ান শহরে যাওয়া হবে না। তাদের ফিরে যেতে হবে।

গত মাসের এ ঘটনা আলজাজিরার কাছে বর্ণনা করছিলেন নেরহায়া ট্যালেডো । তিনি বলেন, এগুলো পৌঁছাতে না পারলে স্থানীয় আদিবাসী ১২০টি লুমাড পরিবারকে খালি পেটেই ঘুমাতে হতো এবং অসুস্থ ব্যক্তিরা ব্যাপক কষ্টের মুখোমুখি হতো। গত বছর বিদ্রোহীরা মারাভি শহর দখল করে নেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মিন্দানাওয়ে মার্শাল ল জারি করা হয়। এর ফলে আদিবাসী জনগোষ্ঠী বড় ধরনের বিপদে পড়ে যায়। তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় কমিউনিস্ট বিদ্রোহীদের সমর্থনের অভিযোগ করা হয়। ২০১৭ সালের মে মাসে জারি করা ওই মার্শাল ল' এ মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তার মেয়াদ সম্প্রতি ২০১৯ সালের শেষ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। জনগণের নিরাপত্তার অজুহাতে এ ব্যবস্থা জারি করা হলেও রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, যাতে শাসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি জনগণের মধ্যে প্রকাশ না পায়, সে জন্যই এ পদক্ষেপ।

লুমাড এলাকার মধ্যে সেনাদের অবাধ চলাচল স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। ট্যালেডো বলেন, সেনারা অবাধে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। ফলে কেউ বাইরে প্রস্রাব করতে গেলেও তাকে কড়া নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। মূলত পুরো এলাকাই সেনাদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছে।

স্কুলে সৈন্যদের অবাধ চলাচল
এর মধ্যে লুমাড স্কুলগুলোও সরকারের নজরদারির কবলে পড়েছে। সরকার দাবি করছে, এ স্কুল থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত ফিলিপাইনের কমিউনিস্ট পার্টির সশস্ত্র শাখা ‘নিউ পিপলস’ আর্মি (এনপিএ) তাদের সদস্য সংগ্রহ করছে।

শিশু অধিকার সংস্থা সেভ আওয়ার স্কুল নেটওয়ার্ক জানায়, তারা ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ওই এলাকায় এ ধরনের দুই হাজার ৮০০টি ঘটনার রেকর্ড করেছে, যাতে দেখা গেছে ৫৬টি স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুই হাজার ২০০ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া স্কুলের মধ্যে সেনাক্যাম্প করার অভিযোগ পাওয়া গেছে আরো ৩০টি।

এখানে অবশ্য কিছু সরকারি স্কুল রয়েছে। কিন্তু সেগুলোতে পড়তে চাইলে লুমাড শিশুদের কয়েক ঘণ্টা হেঁটে স্কুলে পৌঁছাতে হয়।

সেভ আওয়ার স্কুল নেটওয়ার্কের রাইউস ভ্যালে জানান, সরকার চায় না সেখানকার মানুষ তাদের অধিকার সম্পর্কে জানুক। কারণ তারা লিখতে-পড়তে শিখলে তাদের পৈতৃক ভূমি রক্ষার্থে তারা আরো অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠবে। মিন্দানাওয়ের ছয়টি প্রদেশে ছড়িয়ে থাকা লুমাডদের জমির পরিমাণ ১৮ লাখ হেক্টর। এসব জায়গা দিয়েই মিন্দানাওয়ের বেশ কয়েকটি নদী সাগরের সাথে গিয়ে মিলিত হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সোনাসহ অন্যান্য দামি খনিজ পদার্থ কব্জা করতে বিভিন্ন কৌশলে এসব এলাকা দখলে নিতে চাইছে।

স্কুলে সৈনিক
ছয় সপ্তাহ আগে কিছু উপজাতীয় নেতা ট্যালেডো যেখানে পড়ান সে স্কুলটি পরিদর্শন করেন। তখন তাদের সাথে চারজন সৈনিক ছিল। তারা ওই শিক্ষককে একটি চিঠি দেন, যাতে কয়েকদিনের মধ্যে ওই স্কুল খালি করার নির্দেশ দেয়া হয়। পরে তারা সে স্কুলের ভিডিও করে। তখন তাদেরকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তাদের কে পাঠিয়েছে? কিন্তু তারা সে প্রশ্নের জবাব দেয়নি। তারা শুধু এতটুকুই বলেছে যে, আমরা কেবল তাদের সমস্যা সৃষ্টি করছি। প্রথমবার তাদের চিঠির পরও সরে না যাওয়ায় তারা হুমকি দিয়ে বলে, যদি তোমরা শিগগির এ জায়গা ত্যাগ না করো সে ক্ষেত্রে তোমাদের কোনো শিক্ষক কোনোভাবে নিহত হলে তোমরা আবার ভয় পেয়ে বসো না। তার এ কথার পর আমরা আসলেই ভয় পেয়ে যাই। ট্যালেডো বলেন, তিন বছর শিক্ষকতার সময়ে যে কী পরিমাণ হুমকি পেয়েছি তা বলে শেষ করা যাবে না।

তিনি বলেন, আমরা সেখানে শিশুদের লেখাপড়া শিখাতাম। তাদেরকে খাতা ও পেনসিল দিতাম। কিন্তু এখন সময়টা ভীতিকর, বিশেষ করে সেনারা যখন খুব কাছ দিয়ে চলাচল করে তখন সময়টা খুবই ভীতিকর। কান্না লুকাতে লুকাতে লুমাড আরো বলেন, আমরা যে ধরনের শিক্ষা পেয়েছি, এ শিশুদেরও একই রকম শিক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আমরা তাদের সেটাই দেয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু সেনারা আমাদেরকে এমনভাবে হুমকি দেয়, যেন শিক্ষাদান এক ধরনের অপরাধ...।


আরো সংবাদ



premium cement