২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

খাল কেটে ড্রাগন! আন্দামান সাগরে দ্রুত পৌঁছতে নতুন পথের পরিকল্পনায় চীন

এভাবেই থাইল্যান্ডকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে খাল খুঁড়ছে চীন - ছবি : সংগৃহীত

ফের আন্দামান সাগরের দিকে নজর চীনের। মালাক্কা প্রণালী ঘুরে ভারতের দক্ষিণতম বিন্দুর কাছে আর নয়, তার অনেকটা উত্তরে থাইল্যান্ডকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের আরো কাছে সরাসরি পৌঁছতে চাইছে চীন। দরকার শুধু একটা খাল তৈরির। প্রকল্পটি নিয়ে থাইল্যান্ডের সরকারের সঙ্গে আলোচনাও শুরু হয়ে গেছে চীনের। থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুৎ চান-ও-চা সে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সামনে পেশও করে দিয়েছেন চীনের প্রস্তাব।

চীনের জাহাজ হোক বা অন্য কোনো দেশের, চীন সাগরের দিক থেকে আন্দামান সাগরের দিকে আসতে হলে মালাক্কা প্রণালী হয়ে যাতায়াত করতে হয় জাহাজগুলোকে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মাঝে অবস্থিত সঙ্কীর্ণ এই প্রণালী তাই ভূ-কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মুহূর্তে বছরে প্রায় ৮৪ হাজার জাহাজ যাতায়াত করে মালাক্কা প্রণালী দিয়ে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সমীক্ষা বলছে, খুব তাড়াতাড়িই ওই পথে জাহাজ যাতায়াতের সংখ্যা বছরে ১ লাখ ৪০ হাজারে পৌঁছে যেতে পারে।

মালাক্কা প্রণালীর পরিসর যে রকম, তাতে এক বছরে সর্বোচ্চ ১ লক্ষ ২২ হাজার জাহাজকে পথ দেয়ার ক্ষমতা রাখে সেটি। অতএব দক্ষিণ এশিয়ার একটি অর্ধ থেকে অন্য অর্ধে সমুদ্রপথে পৌঁছনোর জন্য খুব শিগগিরই বিকল্প পথ খুঁজতে হবে। চীন সর্বাগ্রে সেই প্রকল্পে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে। থাইল্যান্ডের মধ্যে দিয়ে নতুন খাল খোঁড়ার প্রস্তাব দিয়েছে তারা। চীনা সংস্থাগুলো ওই প্রকল্পে ৩ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরে বিতর্কিত কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করেছে যে চীনা সংস্থা, সেই লংঘাও-কে খাল খোঁড়ার দায়িত্ব দেয়া হবে। থাইল্যান্ডের সামনে চীনের প্রস্তাব এমনই বলে জানা গেছে।

থাইল্যান্ড যদি চিনের প্রস্তাব মেনে নেয়, তা হলে চীনের কী সুবিধা হবে? প্রতিরক্ষা বিশারদ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই খাল খুঁড়তে পারলে অনেক সহজে এবং অনেক তাড়াতাড়ি আন্দামান সাগরে ঢুকে পড়তে পারবে চীনা জাহাজগুলো। চীন সাগরের আর আন্দামান সাগরের মাঝের দূরত্ব অন্তত ১২০০ কিলোমিটার কমে যাবে। এখন মালাক্কা প্রণালী ঘুরে ভারতের দক্ষিণতম বিন্দু ইন্দিরা পয়েন্টের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ঢোকে চীন সাগরের দিক থেকে আসা জাহাজগুলো। থাইল্যান্ডের দক্ষিণাংশে প্রস্তাবিত খালটি খোঁড়া গেলে আরো অনেকটা উত্তরে নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অনেকটা কাছে পৌঁছতে পারবে চীনা জাহাজগুলো।

খালটি শুধু সামরিক যাতায়াতের জন্য খোঁড়ার কথা চলছে এমন নয়। খাল খোঁড়া হলে বাণিজ্যিক পরিবহণও সেখান দিয়েই হবে। কিন্তু বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর পাশাপাশি চীনা যুদ্ধজাহাজগুলোও এখনকার চেয়ে অনেক সহজে ও কম সময়ে ভারতীয় পানিসীমার খুব কাছাকাছি পৌঁছতে পারবে। নয়াদিল্লির উদ্বেগটা সেখানেই বাড়ছে।

প্রকল্পটি নিয়ে থাইল্যান্ডের অন্দরে অবশ্য বিরোধিতা রয়েছে ভালোই। মিসরে সুয়েজ খাল এবং পানামায় পানামা খাল খোঁড়ার পর থেকে ওই সব খাল এবং তার সংলগ্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ আর পুরোপুরি নেই সংশ্লিষ্ট দেশ দু’টির হাতে। আন্তর্জাতিক মহলই মূলত নিয়ন্ত্রণ করে সুয়েজ খাল এবং পানামা খালকে। থাইল্যান্ডের মধ্যে দিয়ে খাল খোঁড়া হলে ওই খাল এবং সংলগ্ন অঞ্চলের অবস্থাও একই রকম হবে বলে সে দেশের কূটনীতিকরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। চীনা বিনিয়োগে যে খাল খোঁড়া হবে, সে হেতু চীনই মূলত ওই এলাকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তাতে থাইল্যান্ডের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হবে বলে ধরে নেয়া হচ্ছে।

থাইল্যান্ডে এই মুহূর্তে গণতন্ত্র নেই। রাজা মহা বজিরালঙ্কর্ণ নিয়মতান্ত্রিক শাসন চালাচ্ছেন সামরিক জুন্টার কথা মতো। প্রধানমন্ত্রী পদে রয়েছেন প্রায়ুৎ চান-ও-চা। তবে দেশে গণতন্ত্র ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে থাইল্যান্ডে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা। চীন চাইছে, সেই সাধারণ নির্বাচনের আগেই ব্যাঙ্ককের সঙ্গে যাবতীয় আলোচনা সেরে ফেলতে। গণতান্ত্রিক সরকার কার্যভার নেয়ার আগেই খাল খোঁড়ার কাজ চীন শুরু করে দিতে চাইছে। কারণ এক বার প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে গেলে তথা এক বার চীনা সংস্থাগুলো খাল খনন প্রকল্পে অর্থ ঢেলে দিলে থাইল্যান্ডের নতুন সরকারের পক্ষেও ওই প্রকল্পের কাজ থামানো কঠিন হবে।

ওয়াকিবহাল মহল বলছে, খাল খোঁড়ার কাজ চলতি বছরে বা ২০১৯-এর গোড়ায় শুরু হলে পরের দশকের শেষ দিকে গিয়ে শেষ হবে। অর্থাৎ ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটি খুঁড়তে বছর দশেক সময় লেগে যাবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদরা বলছেন, ওই খাল খনন প্রকল্পে ব্যাঙ্কক যাতে সম্মতি না দেয়, নয়াদিল্লি এখন তা নিশ্চিত করতেই সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হবে। যদি সব চেষ্টা বিফলে যায়, চীন যদি শেষ পর্যন্ত খাল খনন প্রকল্পের সূচনা করে দিতে পারে থাইল্যান্ডে নতুন গণতান্ত্রিক সরকার আসার আগেই, তা হলে নতুন সরকারকে কাজে লাগিয়ে চীনা পরিকল্পনা ভণ্ডুল করার চেষ্টা হতে পারে। যদি তা-ও সম্ভব না হয়, তা হলে আন্দামান সাগরকে ঘিরে ভারতীয় নৌবাহিনীর তৎপরতা কয়েক গুণ বাড়ানোর পথে হাঁটতে হবে নয়াদিল্লিকে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল