১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিমানবাহী রণতরী সক্ষমতায় চীনের অবস্থান কোথায়?

-

বিশ্বের অন্যতম ও এশিয়ার একমাত্র পরাশক্তি চীন। সামরিক, বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ক্ষেত্রে চীনের দ্রুতগতির অগ্রযাত্রা লক্ষ্যণীয়। এর মধ্যে গত কয়েক দশকে চীনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির বিষয়টি খুবই লক্ষ্যণীয়। ২০১০ সাল পর্যন্ত বেইজিংয়ের নিজস্ব কোন বিমানবাহী রণতরী না থাকলেও দেশটি এখন তিনটি বিমানবাহী রণতরীর মালিক। ২০২৩ সালের মধ্যে চীন চারটি বিমানবাহী রণতরীর মালিক হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। চলুন জেনে নেয়া যাক দেশটির বিমানবাহী রণতরীগুলোর আদ্যোপান্ত।

‘লিয়াওনিং’ চীনের প্রথম বিমানবাহী রণতরী। বিমানবাহী এই যুদ্ধজাহাজটির দৈর্ঘ্য ৩০০ মিটার বা ৯৯০ ফুট। সমুদ্রসীমা নিয়ে জাপান, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়াসহ কয়েকটি দেশের সাথে উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে চীনের এই রণতরী আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব চীন সাগরে মোতায়েন করা হয়।

সমুদ্রে বিরোধ নিয়ে জাপানের সাথে উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে লিয়াওনিংকে সাগরে ভাসানোর মাধ্যমে সমুদ্রসীমা নিয়ে চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিষয়টি প্রকাশ পায়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে নির্মিত একটি জাহাজ কিনে সংস্কার করে এই বিমানবাহী রণতরী তৈরি করা হয়। পরে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয় যে জাহাজটি কোনো অভিযানে অংশ নেবে না। এটি কেবল প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহার করা হবে।

লিয়াওনিংয়ের পূর্ব নাম ছিল ভ্যারেজ। ১৯৮০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের নৌবাহিনী এটি তৈরি করে। তবে কাজ অসম্পূর্ণ ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় এটি ইউক্রেনে ছিল।

পরে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি চীনা প্রতিষ্ঠান জাহাজটি কিনে নেয়। প্রতিষ্ঠানটির উদ্দেশ্য ছিল জাহাজটি দিয়ে ম্যাকাও দ্বীপে ভাসমান বিনোদনকেন্দ্র স্থাপন করা। তবে চীন ২০০১ সালে জাহাজটি নিয়ে নেয় এবং ২০১১ সালের জুন মাসে চীনের সামরিক বাহিনী নিশ্চিত করে যে, সংস্কার করে এটিকে চীনের প্রথম বিমানবাহী জাহাজ হিসেবে ব্যবহার করা হবে।

এরপর দ্বিতীয় বিমানবাহী রণতরীর নির্মাণকাজ শেষ করার অল্পদিনের মধ্যেই তৃতীয় বিমানবাহী রণতরী নির্মাণের কাজ শুরু করে বেইজিং। আর এর মধ্য দিয়েই চীন সবচেয়ে বড় পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নৌশক্তিকে জোরালো চ্যালেঞ্জ জানানোর সক্ষমতা অর্জনের পথে এক কদম এগিয়ে যায়।

চীনা ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, নতুন এই বিমানবাহী রণতরীটি হবে নতুন প্রজন্মের সবোর্ত্তম প্রযুক্তির রণতরী। একইসাথে এই রণতরী হবে সর্বাধুনিক লঞ্চিং সিস্টেম, সর্বাধুনিক মারণাস্ত্র ও যন্ত্রপাতিসজ্জিত।

প্রথম বিমানবাহী রণতরীটি চীন ক্যাসিনো বানাবার কথা বলে ২০ লাখ ডলার দিয়ে কিনে নেয়। পরে এটির বাকি কাজ সমাপ্ত করে চীনা নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এরপর সম্পূর্ণ দেশীয় প্রকৌশলকে কাজে লাগিয়ে দ্বিতীয় বিমানবাহী রণতরী নির্মাণে সফলতা দেখায় বেইজিং। দ্বিতীয় বিমানবাহী রণতরীটিকে টাইপ০০৩ রণতরী হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসেই সকল ট্রায়াল শেষে এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে চীনা নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত (কমিশনিং) করা হয়।

আর তৃতীয় বিমানবাহী রণতরীটি আরো শক্তিশালী ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির। এটি হবে আগের দুটির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এক বিমানবাহী রণতরী। এর নকশা, এর উড্ডয়ন ব্যবস্থা, এর অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি হবে হালফিল প্রযুক্তির। সে কারণে এটির নির্মাণ একইসাথে খুব জটিল আর চ্যালেঞ্জিং।

চীনের সাংহাই জিয়াংনান শিপইয়ার্ডে এটির নির্মাণকাজ অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টসহ বেশকয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম।

তারা বলেছে, নতুন এই সুবিশাল রণতরীর বদৌলতে চীনের নৌ-উড্ডয়ন ব্যবস্থার পরিসীমা ও সক্ষমতা অনেকদূর এগিয়ে যাবে।

বিশাল আকারের কারণে বিমানবাহী রণতরীকে ‘ভাসমান শহর’ বা ‘ভাসমান বিমানবন্দর’ বলেও অভিহিত করা হচ্ছে। এদিক থেকে প্রতিটি বিমানবাহী রণতরী একেকটি মহাতরী। এমন জটিল ও বিপুলায়তন রণতরী নির্মাণে স্বাভাবিকভাবেই ৫ থেকে ১০ বছর লেগে যায়। কিন্তু চীনের তৃতীয় রণতরীর নির্মাণকাজ এমন অবিশ্বাস্য দ্রুতগতি এগোচ্ছে যে, মাত্র ২ বছরেই এর নির্মাণকাজ শেষ হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এই রণতরীতে চীন পুরনো আমলের স্কি-জাম্প ও ক্যাটাপাল্ট ব্যবস্থা বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যবস্থায় সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক লঞ্চিং ব্যবস্থা চালু করবে। যুক্তরাষ্ট ছাড়া আর কোনো দেশেরই, এমনকি রাশিয়ারও, এই প্রয়ুক্তি আয়ত্তে নেই। তবে বহু বছর ধরে চেষ্টা চালিয়েও এই ব্যবস্থাটির প্রয়োগে ১০০ ভাগ সফলতা অর্জন করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট।

প্রসঙ্গত, চীন এখন যুক্তরাষ্ট ও রাশিয়ার সমকক্ষ এক ব্লু-ওয়াটার নেভি বা বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারে সক্ষম একটি নৌবাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে তিনটি রণতরীর মালিকানা এই লক্ষ্য পূরণের পথে চীনকে অনেক দূর এগিয়ে দেবে।

আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে চীন ৪র্থ বিমানবাহী রণতরী তথা চারটি নৌবহরের (এয়ারক্র্যাফ্ট ক্যারিয়ার ব্যাটল গ্রুপ) মালিক হতে চায়। সে ধরনের সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা এ মুহূর্তে বেইজিংয়ের রয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement