যেভাবে মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয় ইন্দোনেশিয়ার পালু শহর
- দ্য টেলিগ্রাফ
- ০১ অক্টোবর ২০১৮, ১২:৪৯, আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৮, ১৩:০৩
গত শুক্রবার ইন্দোনেশিয়ার সুলায়েসি দ্বীপে পরপর দু’টি বড় আকারের ভূমিকম্প আঘাত হানে। এর পরে আঘাত হানে সুনামি। এতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আট শতাধিক লোকের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। উদ্ধারকর্মীরা আশঙ্কা করছেন, সংখ্যাটি আরো অনেক বাড়তে পারে, এমনকি হাজার হাজার হতে পারে। কারণ এখন পর্যন্ত উদ্ধারকারী লোকজন ডোঙ্গালা ও মামুজু শহরের সাথে যোগাযোগই করতে পারেননি।
বিপর্যস্ত সুলায়েসি দ্বীপের লোকজন দুঃখের সাথে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছেন, কিভাবে ১৯২৭ ও ১৯৬৮ সালের মতো কোনো পূর্বসতর্কতা ছাড়াই সুনামিটি আঘাত হানলো?
সেন্সর ও সাইরেন
এবারের দুর্যোগের ফলে ইন্দোনেশিয়ার সতর্কীকরণ সিস্টেমটিও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। কারণ ইন্দোনেশিয়ার ভূতাত্ত্বিক সংস্থা (বিএমকেজি) ওই দুই ভূমিকম্পের ফলে সুনামি সৃষ্টির আশঙ্কায় প্রথমত সতর্কতা জারি করেছিল; কিন্তু ৩৪ মিনিট পরে তা তুলে নেয়। শুক্রবারে পালুর সমুদ্রসৈকতে একটি অনুষ্ঠানে জড়ো হয়েছিল কয়েক শ’ মানুষ। ১৮ ফুট উচ্চতার ঢেউ তাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাদের অধিকাংশেরই মৃত্যু হয়।
রোববার সুলায়েসির দুর্যোগ বিভাগের মুখপাত্র প্রকাশিত এক ভিডিওতে সুনামির প্রথম ঢেউয়ে পানির বিশাল প্রাচীর দেখা যায়, কিন্তু তখনো কোনো সাইরেন বাজেনি। পরে সেই ঢেউ রাস্তায় থাকা লোকজনসহ সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পরবর্তী আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, ঢেউয়ের তোড়ে অনেক কিছু ভেসে যাচ্ছে।
সুনামি সতর্কতা জারি করার পরও এত দ্রুত তা উঠিয়ে নেয়ায় সামাজিক গণমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়েছে বিএমকেজি। তারা জানায়, তারা আধুনিক অপারেটিং সিস্টেমই অনুসরণ করেছিল এবং পালু থেকে ১২৫ মাইল দূরের জোয়ারের সেন্সর থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সতর্কতাটি তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিএমকেজির ভূমিকম্প ও সুনামি সেন্টারের প্রধান রহমত ত্রিইয়োনো বলেন, আমাদের কাছে পালুর কোনো তথ্য ছিল না। পালুর কাছাকাছি জোয়ার পরিমাপক যন্ত্র না থাকায় যথাযথভাবে ঢেউয়ের উচ্চতা নির্ণয় করা যায়নি। তাই আমাদের কাছে যে তথ্য ছিল, তার ভিত্তিতেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং সুনামি সতর্কতা উঠিয়ে নিয়েছি।
তিনি বলেন, সবচেয়ে কাছের যে জোয়ার সেন্সর ছিল, সেটি কেবল সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা মাপতে পারত। এর দ্বারা ছয় সেন্টিমিটার ঢেউ মাপা যেত, এর চেয়ে বড় ঢেউ সেটি মাপতে পারত না। যদি আমাদের কাছে যথাযথ যন্ত্রপাতি থাকত অথবা পালু সম্পর্কে সঠিক তথ্য থাকত তাহলে সেটা হতো উত্তম।
ভবিষ্যতে আমরা এসবের ব্যবস্থা করব। তবে এখনো এটি পরিষ্কার হয়নি যে, পালুকে বিধ্বস্ত করা ওই সুনামিটি কি সতর্কতা তুলে ফেলার আগেই আঘাত হেনেছিল, নাকি পরে। ত্রিইয়োনো বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও পরীক্ষা করে আমরা হিসাব করেছি, সতর্কতা তুলে ফেলার আগেই সুনামিটি আঘাত হেনেছিল।
ইন্দোনেশীয় সরকারের সাথে কাজ করা সুনামি গবেষণাদলের প্রধান আবদুল মুহারি বলেন, এ ক্ষেত্রে যোগাযোগের সমস্যাটির বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। কারণ বিএমকেজি যখন স্থানীয়পর্যায়ের লোকজনের সাথে যোগাযোগ করতে চাচ্ছিল, তখন কোনো লাইনই সচল ছিল না। ফলে তারা সতর্কতা তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের লোকজন যখন স্থানীয়দের সহজভাবে সুনামি সতর্কতার বিষয়টি বুঝানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখনই হঠাৎ করে সতর্কতাটি তুলে নেয়া হয়। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় পরবর্তী সময়ে আবারো টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে সুনামি সতর্কতা জারির বিষয়টি জানানোর চেষ্টা চালাচ্ছিল, কিন্তু ভূমিকম্পের ফলে ওই এলাকার বিদ্যুৎ ও যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, ফলে কোনো সাইরেনও শোনা যায়নি।
ফানেল প্রভাব
আবদুল মুহারি বলেন, তিন লাখ আশি হাজার মানুষের বসতি পালুতে সুনামি মেকানিজমটাই তাদেরকে বিভ্রান্ত করে ফেলেছে। এলাকাটির ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সুনামি আঘাত হেনেছে ফানেলে ঢোকার মতো করেই। ফলে সমুদ্রে জায়গাটিতে সুনামিটি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক শক্তিশালী ও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। এ কারণেই খুব দ্রুত এটি এলাকাটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে।
আরো পড়ুন: ইন্দোনেশিয়ার মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, রাস্তায় রাস্তায় লাশ
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮
ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপে শুক্রবারের ভূমিকম্প এবং সুনামিতে নিহতের সংখ্যা ৮০০ ছাড়িয়ে গেছে। দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট বলছেন, মৃতের সংখ্যা 'হাজার হাজার' হতে পারে। রাস্তায় রাস্তায় দেখা যাচ্ছে লাশ।
ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় দুর্যোগ বিভাগ রোববার তাদের সর্বশেষ যে হিসাবে দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে শুক্রবারের ভূমিকম্প এবং তা থেকে সৃষ্ট সুনামিতে সুলাওয়েসি দ্বীপে কমপক্ষে ৮৩৪ জন মারা গেছে।
কিন্তু কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন হতাহতের সংখ্যা কয়েক গুণ বাড়তে পারে। ইন্দোনেশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট ইউসুফ কাল্লা বলেছেন, নিহতের সংখ্যা 'হাজার হাজার' হতে পারে।
কেন এই আশঙ্কা - দুর্যোগের দুদিন পর তার কারণ ব্যাখ্যা করতে শুরু করেছেন ইন্দোনেশিয়ার কর্মকর্তারা।
শুক্রবারের ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প এবং তার ফলে সৃষ্ট ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস সুলাওয়েসি দ্বীপের পালু এবং আরো কয়েকটি শহরে আঘাত করে।
জাতীয় দুর্যোগ বিভাগ বলছে, তারা প্রথমে যা ভেবেছিলেন ভূমিকম্প এবং সুনামিতে আরো বেশি জনপদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, বহু মানুষ এখনও বিধ্বস্ত ঘরবাড়ির নীচে আটকা পড়ে আছে।
পালু শহরে মানুষজন নিজেরাই ধ্বংসাবশেষের নিচে স্বজন প্রতিবেশীদের খুঁজছেন।
দুর্যোগ বিভাগের কর্মকর্তা মুহাম্মদ সাউগি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, "ধ্বংসস্তূপ সরাতে আমাদের এখন জরুরী ভিত্তিতে ভারী যন্ত্রপাতি দরকার। শরীরের শক্তি দিয়ে একাজ আর সম্ভব হচ্ছে না।"
ডঙ্গালা নামক একটি শহরের পরিণতি নিয়ে গভীর আশঙ্কা রয়েছে। প্রত্যন্ত এই শহরটি থেকে এখনও তেমন কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছেনা।
রেডক্রস বলেছে, ১৬ লাখের মত মানুষ শুক্রবারের ভূমিকম্প ও সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি বলছে 'এই ট্রাজেডি আরো করুণ চেহারা নিতে পারে।'
শহরের ৩,৩৫,০০০ মানুষের অনেকে এখনও নিখোঁজ। আশঙ্কা করা হচ্ছে বহু মানুষ বিধ্বস্ত ঘরবাড়ির নিচে আটকা পড়ে আছে।
শহরের রোয়া রোয়া নামে একটি হোটেলের ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধারকারীরা ২৪ জনকে জীবিত বের করে এনেছেন। আরো অনেক সেখানে আটকা পড়ে আছে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন শহরের রাস্তায় রাস্তায় মৃতদেহ ছড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। খোলা জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
আফটার-শক অর্থাৎ বড় ভূমিকম্পের পর ছোটো ছোটে যে কাঁপুনি হয়, তার ভয়ে শনিবার সারারাত পালুর লোকজন ঘরের বাইরে ছিলেন।
একটি আশ্রয় কেন্দ্রে বসে পালুর বাসিন্দা রিসা কুসুমা এএফপি সংবাদ সংস্থাকে বলেন, "প্রতি মিনিটে অ্যাম্বুলেন্সে করে মৃতদেহ আসছে। খাবার পানি প্রায় পাওয়াই যাচ্ছে না। দোকানপাট বাজার সব লুট হয়ে যাচ্ছে।"
কেন এত মানুষ মারা গেল?
শুক্রবার ৭ দশমিক ৫ মাত্রার যে ভূমিকম্প হয় তার উৎপত্তিস্থল ছিল উপকূলের খুব কাছে, মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে। ফলে খুব দ্রুত জলোচ্ছ্বাস তীরে চলে আসে।
স্থানীয় একটি উৎসবের কারণে সে সময় বহু মানুষ পালুর সমুদ্র সৈকতে ছিল। ফলে তাদের অনেকেই সুনামি থেকে পালানোর সময় পায়নি।
ঘরবাড়ি ছাড়াও ভূমিকম্প ও সুনামিতে শহরের শপিং মল, মসজিদ, হোটেল, সেতু বিধ্বস্ত হয়েছে।
পালু বিমানবন্দরের একজন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারও মারা গেছেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা