১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সু চিকে নিয়ে যা বললেন মাহাথির

রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিতে এবং তাদের ফেরার সব পথ বন্ধ করতে আরসা - ছবি : সংগৃহীত

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সাথে দেশটির রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চির ভূমিকা নিয়ে তীব্র হতাশার কথা জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির। রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের সমালোচনা করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। 

গত বছরের ২৫ আগস্ট নিরাপত্তা চৌকিতে আরসার হামলাকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের কারণ বলা হলেও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিতে এবং তাদের ফেরার সব পথ বন্ধ করতে আরসার হামলার আগে থেকেই পরিকল্পিত সেনা অভিযান শুরু হয়েছিল। চলমান জাতিগত নিধনে হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় সাড়ে ৭ লাখ মানুষ।

রোহিঙ্গাদের বিপন্নতার ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আধুনিক মালয়েশিয়ার এই রূপকার। তাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ করতে না পারায় অং সান সু চিকে নিয়ে ‘খুবই হতাশ’ তিনি। মাহাথির মিয়ানমার সম্পর্কে বলেছেন, ‘তারা যা করেছে, তা সত্যিই অবিচার। মানুষকে হত্যা করা আর গণখুনের মতো ঘটনাগুলো কোনো সভ্য দেশের আচরণ হতে পারে না।’

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ ও জাতিসঙ্ঘের সাথে প্রত্যাবাসন চুক্তি করতে বাধ্য হয় মিয়ানমার। তবে জুলাই মাসে রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের ভূমিকায় শঙ্কা প্রকাশ করে মানবাধিকার কমিশন। ‘ইউনাইটেড নেশনস হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল’ কর্তৃক নিযুক্ত মিয়ানমারে মানবাধিকার পর্যবেক্ষণবিষয়ক বিশেষ দূত ইয়ানঘি লি সে সময় জানান, দেশটিতে অবস্থানরত অনেকের সাথে টেলিফোনে আলাপ করতে গিয়ে তিনি মিয়ানমারের এমন সব পদক্ষেপের কথা জেনেছেন, যা শঙ্কিত হওয়ার মতো। লি মন্তব্য করেছেন, এখনো রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর মতো উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত হয়নি।

আরো পড়ুন :

গোপন নথি ফাঁস হওয়ায় ফেঁসে গেছে মিয়ানমার
ইরাবতি ও রয়টার্স 

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে জাতিসঙ্ঘের দুই সংস্থার সঙ্গে স্বাক্ষরিত সমঝোতা চুক্তির গোপন খসড়াটি কে বা কারা ফেসবুকে ফাঁস করেছে তা জানার চেষ্টা করছে মিয়ানমার সরকার। এ নথি কি জাতিসঙ্ঘ সংশ্লিষ্ট কেউ ফাঁস করেছে কিংবা কূটনীতিকদের কেউ এ কাজ করেছেন নাকি সাংবাদিকরা তা ফাঁস করেছেন; তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের মুখপাত্র উ জ হতেকে উদ্ধৃত করে দেশটির সংবাদমাধ্যমে এই সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে।

গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। জাতিগত নিধন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা। মিয়ানমার শুরু থেকেই রোহিঙ্গাদের বাঙালি মুসলিম আখ্যা দিয়ে নাগরিকত্ব অস্বীকার করে আসছে।

তবে এবারের ঘটনায় আন্তর্জাতিক চাপ জোরালো হওয়ার একপর্যায়ে প্রত্যাবাসন চুক্তিতে বাধ্য হয় মিয়ানমার। তবে সেই চুক্তির আওতায় এখনো একজন রোহিঙ্গাকেও ফিরিয়ে নেয়নি মিয়ানমার। এরমধ্যেই গত ৬ জুন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে মিয়ানমারের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে জাতিসঙ্ঘ। তবে সেখানেও নাগরিকত্ব প্রশ্নটি উপেক্ষিত।

জাতিসঙ্ঘ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক নিয়ে বিস্তারিত প্রকাশ না করা হলেও গত ২৯ জুন তা অনলাইনে ফাঁস হয়। ‘ইয়াঙ্গুন ইনফরমার’ নামের একটি ফেসবুক পেজে ৮ জুন স্বাক্ষরিত ওই সমঝোতা চুক্তির কয়েকটি নথি ফাঁস করা হয়। দাবি করা হয়, এগুলোতে চুক্তির বিস্তারিত আছে।

ওই নথি পর্যালোচনা করে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়, খসড়া চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের জাতিগত স্বীকৃতি মেলেনি। উপেক্ষিত হয়েছে তাদের নাগরিকত্বের দাবি।

মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের মুখপাত্র উ জ হতে’র কাছে ফাঁস হওয়া নথির সত্যতা নিয়ে জানতে চেয়েছিল দেশটির সংবাদমাধ্যম ইরাবতি। তবে ওই নথিগুলোর সত্যতা নিশ্চিত করতে অস্বীকৃতি জানান জ হতে। তিনি শুধু বলেন, কে বা কারা নথিগুলো ফাঁস করেছে তা জানতে তদন্ত করা হচ্ছে। তারা জানতে পেরেছেন, অনেক সাংবাদিক ওই পেজটি অনুসরণ করেন।  

জ হতে বলেন, ‘আমরা পরীক্ষা করে দেখব যে ফেসবুক পেজটি জাতিসঙ্ঘ সংশ্লিষ্ট কেউ কিংবা কূটনীতিক অথবা সাংবাদিকদের কেউ তৈরি করেছেন কিনা। যদি তাদের কেউ এটা করে থাকেন, তবে সেটা হবে নীতিগত লঙ্ঘন। এর দায় তাদেরকে নিতে হবে। এটি একটি গোপন নথি।’

তিনি আরো জানান, এ নথি ফাঁসের ঘটনায় সরকারযথাযথ প্রমাণ সংগ্রহ করবে এবং যদি জাতিসঙ্ঘের কারো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়, তবে জাতিসঙ্ঘের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করবে।

জ হতে স্বীকার করেছেন, এটাই প্রথম নথি ফাঁসের ঘটনা নয়। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তির একটি ফাঁসকৃত কপিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে পড়েছিল। এ ধরনের প্রবণতাকে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।

মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও জাতিসঙ্ঘের মধ্যকার সমঝোতা স্মারকটির(এমওইউ) ফাঁস হওয়া অনুলিপি পর্যালোচনার পর রয়টার্স জানিয়েছে, সই হওয়া গোপন চুক্তিতে দেশটিতে ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কিংবা সারা দেশে স্বাধীনভাবে চলাচলের কোনো প্রকাশ্য নিশ্চয়তা নেই।

শুক্রবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক খবরে এ তথ্য জানানো হয়েছে। সমঝোতা স্মারককে উদ্ধৃত করে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,এতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। নাগরিকত্বের প্রশ্নের মীমাংসা কী হবে তাও স্পষ্ট নয়। প্রত্যাবর্তনকারী সবাইকে যথাযথ পরিচয়পত্রের কাগজ ও তারা যাতে স্বেচ্ছায় মুক্তভাবে ফিরতে পারেন, মিয়ানমার সরকারকে তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।

চুক্তির খসড়া অনুযায়ী রাখাইনে অন্যান্য অধিবাসীদের মতোই প্রচলিত আইন মেনে স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকার ভোগ করবেন ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গারা। তবে রাখাইন রাজ্যের সীমানার বাইরেও তারা স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারবে কিনা, সেই নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি।

এমনকি বর্তমানে যে আইন ও নীতিমালা দিয়ে রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাফেরার অধিকার রোধ করা হয়েছে, তা সংশোধনের প্রতিশ্রুতিও সেখানে নেই। রয়টার্সের সাম্প্রতিক এক অনুসন্ধানেও নিশ্চিত করা হয়েছে, ৮২ সালে প্রণীত যে নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের কার্যত রাষ্ট্রহীন করে রাখা হয়েছে, তা পর্যালোচনার কোনো পরিকল্পনা আপাতত নেই। 

জাতিসঙ্ঘ-মিয়ানমার গোপন চুক্তিতে কি আছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে

চলতি বছর মে মাসে জাতিসংঘ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পাদিত গোপন চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা বা গ্যারান্টি নেই বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার এবং জাতিসংঘের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। চুক্তির পর সেই বিষয়ে কোনো পক্ষই প্রকাশ্যে কিছু জানায়নি।

শুক্রবার রয়টার্স দুই পক্ষের মধ্যে করা সমঝোতা স্মারক পর্যবেক্ষণ করে এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এমনকি এটা অনলাইনেও ফাঁস হয়ে যায়। সমঝোতা স্মারকে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গারা ফিরে গিয়ে রাখাইনে বাস করা অন্যান্য সব গোষ্ঠীর মতোই স্বাধীনতা ভোগ করবে।

চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গারা সেখানকার নিয়ম-কানুন মেনে চলবে। এর ফলে রোহিঙ্গারা রাখাইনের বাইরে চলাফেরা করতে পারবে না। অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যেই নিয়ন্ত্রিত চলাফেরা করতে হবে। তারা মিয়ানমারের নাগরিকত্ব পাবে না। অথচ জাতিসংঘের প্রধান লক্ষ্য ছিল, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ফেরানো এবং তাদের নাগরিকত্ব প্রদান করা। কিন্তু সেই মূল বিষয়ে চুক্তিতে কিছু উল্লেখ নেই।

মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র জ হাটয় এবং সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী উইন মায়াট এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে রাজি হন নি।

অন্যদিকে শ্রম, অবিভাসনএবং জনসংখ্যা বিষয়ক পরিচালক বলেন, তিনি এ ব্যাপারে মন্তব্য করার যথাযথ কর্তৃপক্ষ নন।

মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এই চুক্তিটি ব্যর্থ। প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।


আরো সংবাদ



premium cement