১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

যেখানে গিয়ে রোহিঙ্গারও দুঃখের কথা ভুলে যায়

যেখানে গিয়ে রোহিঙ্গারও দুঃখের কথা ভুলে যায় - ফাইল ছবি

মিয়ারমারের রাখাইনে এখনো নির্যাতন চলছে। এখনো পালাচ্ছে মানুষ। এমনই ৭৯ জন রোহিঙ্গা নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে একটি নৌকায় করে গন্তব্যহীন পথে যাত্রা শুরু করে। একপর্যায়ে তারা পৌঁছায় থাইল্যান্ডের কাছে। কিন্তু সেখানকার নৌবাহিনী তাদের পথ রোধ করে দাঁড়ায় এবং অন্যত্র রওনা করিয়ে দেয়। অনিশ্চয়তা আরো বাড়ে। একপর্যায়ে তারা সিদ্ধান্ত নেয় মালয়েশিয়া যাওয়ার। কিন্তু তার আগেই তারা পৌঁছে যায় আচেহ প্রদেশে। এটি ইন্দোনেশিয়ার ওই এলাকাগুলোর একটি যেখানে পুরোপুরি শরিয়া শাসন চলে। ২০০৪ সালে সুনামিতে যে এলাকাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এই আচেহ তার একটি। কিন্তু ওই রোহিঙ্গাদের কাছে আচেহদের যে পরিচয়টি সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে সেটি হলো- বিশ্বে এটিই একমাত্র এলাকা, যেখানে খোলাখুলিভাবে রোহিঙ্গাদের স্বাগত জানানো হয়। যেখানে রোহিঙ্গাদের নিজেদের ভাইবোনের মতোই মনে করা হয়।
উল্লেখ্য, মিয়ানমারের মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রোহিঙ্গাকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বন্ধুহীন একটি সম্প্রদায়। তাদের বাড়িঘরে হামলা ও নির্যাতন শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত জাতিসঙ্ঘের হিসাবে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছে।
২০১৫ সালে এখানে প্রথম ৯ জন রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়। তারপর হতে এ পর্যন্ত ১৭৪০ রোহিঙ্গা সেখানে আশ্রয় নিয়েছে।

বাবা-মায়ের মতো যত্ন নেয়
রোহিঙ্গারা যখন এই এলাকায় নামে, তখন তাদের বুক দুরুদুরু করছিল। কারণ তারা জানত না, তাদের সাথে কেমন ব্যবহার করা হবে। কিন্তু নামার পরে যখন স্থানীয়দের সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয় তখন তাদের সব ভয় উবে যায়। কারণ তারা এখানে খাবার, ওষুধ, আশ্রয় সবকিছুই পায়। আইওএম এবং স্থানীয় কিছু সমাজকল্যাণ এজেন্সির আওতায় তাদের আপাতত থাকতে দেয়া হয় একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে। রমযানের পরই তাদেরকে ল্যাঙচা শহরে আরেকটু ভালো ও স্থায়ী ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে। রোহিঙ্গারা এখানে এসে তাদের দুঃখের অনেকটাই ভুলে যায়। তারা এজন্য অন্তর থেকে আচেহবাসীদের ধন্যবাদ জানাতে চায়।

অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা
এখানে যেসব রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে, তারা অম্ল-মধুর অবস্থার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। এখানে তারা যেসব সুবিধা পাচ্ছে, তার জন্য তারা আনন্দিত। কিন্তু তাদের পরিবারের অন্য যে সব সদস্য রাখাইনে রয়ে গিয়েছে, তাদের জন্য দরকার অর্থের। আর সে জন্য দরকার কাজের। রোহিঙ্গাদের অনেকেই তাই মালয়েশিয়ায় চলে যেতে চায়। কারণ সেখানে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে, যাদের কোনো কাজ করার অনুমতি নেই, তবুও তারা সেখানে বিভিন্ন পন্থায় কাজ করে অর্থ উপার্জন করছে। দুশ্চিন্তার কারণ হচ্ছে, আচেহতে তারা যেভাবে সমাদর পেয়েছে, মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে অবস্থা অনেকটাই ভিন্নতর। আবার মালয়েশিয়াতে যাওয়ার জন্য কোনো ব্যবস্থাও তাদের জন্য ঠিক করা নেই।

আবাসনের ব্যবস্থা
আচেহর বিরেউয়েন, যেখানে রোহিঙ্গাদের রাখা হয়েছে, সেখানে ঘিয়ে এবং গাঢ় সবুজ রঙের ভবন রয়েছে। সেখানে পুরুষ ও নারীদের পৃথক ডরমিটরি রয়েছে। রয়েছে একটি মসজিদও সেখানে সবাই মিলে নামাজ আদায় করেন। রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখতে সেখানে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ ক্লিনিকও। সেখানকার তরুণ-যুবক আচেহ স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের দায়িত্ব পালনে বেশ তৎপর। কারণ তারা মনে করে, রোহিঙ্গারা আমাদের ভাই, আমাদের মুসলিম ভাই। আর আমি বা আমরা যা করছি তা আহেচনিজ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব।
ইউএনএইচসিআরের পক্ষ থেকে যখন এ ক্যাম্প পরিদর্শন করা হয়, তখন তারা বলেন, রোহিঙ্গারা এখানে খুবই ভালো আছেন। রোহিঙ্গারা যখন এ ব্যাপারে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করতে যায়, তখন কৃতজ্ঞতায় তারা কেঁদে ফেলে। আচেহনিজরা খুবই ধার্মিক, অমায়িক ও সহায়ক।

আমি এখনো বেঁচে আছি
আচেহর ওই ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা জুলফিকারও ওই ক্যাম্পেই ঘুমাতেন। তিনি আনন্দের সাথেই বলেন, আমি ২২ দিন ধরে আমার স্ত্রীকে দেখিনি। আচেহর সামুদ্রিক আইন হিসেবে, আমরা কোনো আগমনকারীকে ধর্ম, বর্ণ বা কোনো কিছুই জিজ্ঞাসা করি না। কারণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জীবন বাঁচানো, তার জাতীয়তা নয়।
তিনি বলেন, ২০০৪ সালের সুনামির পরও আমি বেঁচে আছি। অথচ ওই সময়ে এ এলাকাতে মারা গিয়েছিলে লক্ষাধিক লোক। সুতরাং আমরা জানি এ ধরনের বিপর্যয়ের পর বেঁচে থাকতে কতটা ভালো লাগে।

রমজানের ব্যস্ততা
প্রথম রমজানে ইফতারের সময় ছিল ৬টা ৪৫ মিনিটে। তার জন্য প্রস্তুতি নিতে ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করে যাচ্ছিলেন। ইফতারের জন্য রান্না করা হচ্ছিল ভাত, মাছ, নুডুলস, শসার সালাদ, নারকেলের দুধে গরুর গোসতের তরকারি, বেগুন ভাজা ইত্যাদি। এগুলো সবই এসেছে অনুদান থেকে। রোহিঙ্গাদের কেউ কেউও রান্না করছিলেন, আবার কেউ বা জুস তৈরি করছিল।

মাগরিবের আজান হতেই পুরুষরা এক দিকে এবং নারী ও শিশুরা আরেক দিকে ইফতারি করতে শুরু করে। খেজুর, স্থানীয় মিষ্টান্ন ইত্যাদি দিয়ে ইফতার শুরু করা হয়। ইফতার শেষে পুরুষরা মসজিদে সবাই একসাথে নামাজ আদায় করতে ছুটে যায়, অন্য দিকে নারীরা তাদের ডরমেটরিতে নামাজ আদায় করে নেয়। সব কিছুর পরও তাদের কারো কারো মনে হাহাকার রয়েই যায়। বিশেষ করে যাদের পরিবার-পরিজন অন্য কোথায় আশ্রয় নিয়েছে, তারা কিভাবে রয়েছে, ভবিষ্যৎ কী এসব তাদের মনে মাঝে মধ্যেই চিন্তার ঢেউ তোলে।
সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান

 


আরো সংবাদ



premium cement