২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ঢাকাবাসী মেট্রোরেলে চড়তে পারবেন

-

রাজধানীর যানজট নিরসনে উড়াল সড়ক, বাসের বিশেষ লেন নির্মাণসহ নানা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে বা হচ্ছে। তবে আধুনিক নগরপরিকল্পনায় ও গণপরিবহনে সবচেয়ে কার্যকর হিসেবে দেখা হয় মেট্রোরেলকে। আশার খবর হলো মেট্রোরেলের জন্য নির্মিত উড়ালপথে রেললাইন বসানো শুরু হচ্ছে চলতি মাসেই। আগামী জুনে ইঞ্জিন-কোচ চলে এলে সেগুলো ঠিকঠাকমতো বসানোর পর শুরু হবে পরীক্ষামূলক চলাচল। সব কিছু পরিকল্পনামতো এগোলে আগামী ২০২১ সালের শেষে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ঢাকাবাসী বহুল প্রতীক্ষিত মেট্রোরেলে চড়তে পারবেন।
যানজট নিরসন, বিপুল সংখ্যায় যাত্রী দ্রুত পরিবহনের জন্য উন্নত বিশ্বে মেট্রোরেল সমাদৃত। ঢাকার সবচেয়ে ব্যস্ত পথগুলোর একটি হচ্ছে মিরপুর থেকে মতিঝিল। এই পথে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। প্রথমে সেবা সংস্থার লাইন অপসারণ ও বসানোর জন্য খোঁড়াখুঁড়ি চলে। এরপর পাইলিং, পিলার তৈরিসহ নানা কর্মযজ্ঞ। ব্যস্ততম সড়কে এই কর্মযজ্ঞ রাজধানীবাসীর জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে আছে দীর্ঘ দিন। বর্ষায় পানি জমে থাকা, শীতে ধুলার রাজ্য, রাস্তা সরু হওয়ার ফলে তীব্র যানজট, নির্মাণ এলাকায় এডিস মশার প্রজনন, বায়ুদূষণের মতো বিষয়গুলো ঢাকাবাসীকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। তবে মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর দ্রুতগতির এই সেবা সব কষ্ট ভুলিয়ে দেবে বলে মনে করছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।
সরকার ২০০৫ সালে ঢাকার জন্য ২০ বছরের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) অনুমোদন করে। এতে যানজট নিরসনে ২০২৪ সালের মধ্যে একাধিক মেট্রোরেলসহ নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের পরামর্শ দেয়া হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন গঠন করা হয় ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি (ডিএমটিসিএল)। ২০১৫ সালে জাপানের সহায়তায় এসটিপি সংশোধন (আরএসটিপি) করে মেট্রোরেলের রুট সংখ্যা বাড়ানো হয়। ঢাকার যানজট নিরসনে সরকার ছয়টি মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার মেট্রোরেলের কাজের মোট অগ্রগতি নভেম্বর পর্যন্ত ৩৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের আট কিলোমিটার উড়ালপথ তৈরির কাজ শেষ। জাপানের সহায়তায় এই মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, উত্তরা মতিঝিল মেট্রোরেলের কাজে আর্থিক ও কারিগরি কোনো বাধা নেই। তবে স্টেশন থেকে ফুটপাথে মানুষ নামার পর যাতে ভিড় না লেগে যায়, সে জন্য বড় জায়গা দরকার। শুরুর পরিকল্পনায় এটা ছিল না। এখন নগরের ব্যস্ত এলাকার স্টেশনগুলোর নিচে এ জন্য বাড়তি জায়গা খোঁজা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কিছু স্থাপনা ভাঙা পড়তে পারে। এ ছাড়া মেট্রোরেলের নির্মাণ ও পরিচালনার ব্যয় বিপুল। এটা বিবেচনায় নিলে বড় অঙ্কের যাত্রী ভাড়া ধরতে হবে। এ জন্য সরকার ভর্তুকি দিয়ে ভাড়া কম রাখার চিন্তা করছে। তবে এখনো ভাড়ার হার ঠিক হয়নি।
উত্তরা থেকে মতিঝিল মেট্রোরেল প্রকল্প ২০১২ সালের ডিসেম্বরে একনেকে অনুমোদিত হয়। ২০১৩ সালের ফেব্র“য়ারিতে জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত স্টেশন হবে ১৬টি। শুরুতে ২৪টি ট্রেন দিয়ে মেট্রোরেল চালু করার কথা রয়েছে। প্রতিটি ট্রেনে প্রাথমিকভাবে ছয়টি করে বগি থাকবে। পরে তা আটটিতে উন্নীত করার পরিকল্পনা আছে। প্রাথমিক হিসাব অনুসারে, শুরুতে দিনে চার লাখ ৮৩ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। ২০৩৫ সালে যাত্রীসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১৮ লাখের বেশি।
মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে মতিঝিলে যেতে লাগবে ৩৮ মিনিট। ঘণ্টায় দুই দিক থেকে ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা দিচ্ছে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকা। বাকিটা সরকার বহন করছে।
উত্তরায় মেট্রোরেলের ডিপো এলাকায় ভূমি উন্নয়নের কাজটি করেছে জাপানের টোকিও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। এখন চলছে ডিপোর অবকাঠামো নির্মাণকাজ। এই কাজের ঠিকাদার থাইল্যান্ডভিত্তিক ইতালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি ও চীনের সিনো হাইড্রো। ২০১৭ সালে শুরু হওয়া এই কাজের অগ্রগতি ৫৭ শতাংশ।
উত্তরা থেকে আগারগাঁওয়ের দূরত্ব ১১ দশমিক ৭৪ কিলোমিটার। এই অংশে নয়টি স্টেশন নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে উত্তরায় দু’টি স্টেশনের লাউঞ্জ নির্মাণের কাজও চলছে। এই অংশের কাজ শুরু হয়েছে ২০১৭ সালের আগস্টে। ঠিকাদার ইতালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি। এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ৫৯ শতাংশ। এর মধ্যে উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে মিরপুরের দিকে আট কিলোমিটার উড়ালপথ নির্মাণ শেষ হয়েছে। পৌনে দুই কিলোমিটার পথে রেললাইন বসানোর জন্য ঠিকাদারকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।
আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার অংশের দূরত্ব ৩ দশমিক ২০ কিলোমিটার। এই অংশে তিনটি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। গত বছরের আগস্টে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। এই কাজ করছে জাপানের টেক্কেন করপোরেশন, বাংলাদেশের আবদুল মোনেম ও জাপানের এবি নিক্কন কোইগো। এ পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ৩৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ৭০ শতাংশ পাইলের কাজ শেষ হয়েছে। ২০ শতাংশ পাইলের মুখ অর্থাৎ মাটির ওপর ক্যাপ বসেছে। এর ওপর পিলার উঠবে। এরই মধ্যে একটি পিলার উঠে গেছে। পিলারের ওপর স্ল্যাব বসানো হবে। এখন পর্যন্ত ২২টি স্ল্যাব নির্মাণ করা হয়েছে। মোট এক হাজার ৪৮টি স্ল্যাব লাগবে।
কারওয়ান বাজার থেকে মতিঝিল (বাংলাদেশ ব্যাংক) পর্যন্ত ৪ দশমিক ৯২ কিলোমিটার অংশে স্টেশন হবে চারটি। গত বছরের আগস্ট থেকে কাজটি করছে জাপানের সুমিতুমো মিটসুই কনস্ট্রাকশন ও ইতালিয়ানুথাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি। এর মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি পাইলের কাজ শেষ হয়েছে। ১৮টি পিলার নির্মাণ হয়ে গেছে। ১২টিতে স্ল্যাব বসানোর মতো অবকাঠামো প্রস্তুত। কাজের মোট অগ্রগতি ৩৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
মেট্রোরেলের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্থাপন এবং রেললাইন বসানোর কাজটি পেয়েছে জাপানের মারুবেনি ও ভারতের এল অ্যান্ড টি। রেললাইন নির্মাণের পাত ও বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন নির্মাণের তার উত্তরায় এসেছে। আগামী ২০ ডিসেম্বর উত্তরার ডিপো এলাকায় রেললাইন বসানোর কাজ উদ্বোধন করতে পারেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এরপর লাইনে বিদ্যুতের খুঁটি এবং ট্রেনের সাথে বিদ্যুতের লাইন স্থাপনের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হবে। এই কাজের অগ্রগতি ২৪ দশমিক ৪১ শতাংশ।
মেট্রোরেলের ইঞ্জিন-কোচ ও ডিপোর মালামাল সংগ্রহের কাজটি করছে জাপানের কাওয়াসাকি ও মিতসুবিশি কনসোর্টিয়াম। ইঞ্জিন-কোচ নির্মাণের পুরো কাজই হচ্ছে জাপানে। আগামী জুনে ইঞ্জিন-কোচ বাংলাদেশে আসা শুরু হবে। এরপর সেগুলো পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হবে। ইঞ্জিন-কোচের নকশা করার পর চলতি বছরের ফেব্র“য়ারি মাসে ইঞ্জিন এবং এপ্রিলে বগি নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ২০ শতাংশ।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ডিসেম্বরেই রেললাইন বসানো শুরু হয়ে যাবে। এরপর ট্রেন চলে আসলে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মেট্রোরেল চালু করা যাবে।

২০৩০ সালের মধ্যে মোট ছয়টি মেট্রোরেল
সরকারের সংশোধিত পরিকল্পনা অনুসারে, ঢাকা ও এর আশপাশের উপশহরগুলোকে সচল রাখতে ১৩১ কিলোমিটার মেট্রোরেল দরকার। সে অনুযায়ী, সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে মোট ছয়টি মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। এগুলো তিন পর্বে বাস্তবায়িত হবে। আরএসটিপির সমীক্ষা বলছে, ছয়টি মেট্রোরেল নির্মিত হলে দৈনিক প্রায় ৫২ লাখ যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে আরো পাঁচটি মেট্রোরেল নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে দুটি মেট্রোরেলের প্রস্তুতি অনেকদূর এগিয়েছে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে ঢাকার চেহারা পাল্টে যাবে। ঢাকা ও এর শহরতলিকে যুক্ত করতে বাকি পাঁচটি মেট্রোরেল পাতাল ও উড়ালপথে হবে। এর মধ্যে দুটির প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার ব্যয় বিপুল। ফলে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়িত না হলে ব্যয় বাড়বে। ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে গিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়তে হবে। তাই মেট্রোর সাথে সমন্বয় করে শহর গড়ে তুলতে না পারলে এর পুরো সুফল পাওয়া যাবে না।


আরো সংবাদ



premium cement