২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ঢাকার জলাবদ্ধতা কমবে কবে

-

মুষলধারে বৃষ্টি হলেই ঢাকাবাসীর আর রক্ষা নেই। গত শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে হাঁটু পানি জমে যায়। নিদারুণ দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়লে জলাবদ্ধতাও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তির জন্য বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়ন দৃশ্যমান হচ্ছে না। গত শুক্রবারই ভারী বর্ষণের পর চলমান বৃষ্টিতে ঢাকার বহু অঞ্চল জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। স্থবির হয়ে গেছে সার্বিক নাগরিক জীবন যাত্রা।
চলতি বর্ষা মওসুমে রাজধানীতে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছে না। এমনকি ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। গত কয়েক দিনেও তার নমুনা পাওয়া গেছে। মাঝারি বর্ষণেই রাজধানীর অনেক এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। ফলে ভারী বৃষ্টিপাত হলে জলাবদ্ধতা যে ভয়াবহ রূপ নেবে এতে কারো সন্দেহ নেই। বিষয়টি অস্বীকার করছেন না ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারাও।
ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জলাবদ্ধতায় যাতে দুর্ভোগ না হয় সেজন্য এবার সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ড্রেনের উপরিভাগে কিছুটা পরিষ্কার করা হয়েছে। শান্তিনগর, গুলশান, বনানী, বারিধারা ও কুড়িল এলাকায় ড্রেনেজ সিস্টেমের আধুনিকায়ন করা হয়েছে। খিলক্ষেত এলাকার সাড়ে তিন কিলোমিটার ও প্রগতি সরণির মালিবাগ পর্যন্ত এলাকায় নতুন ড্রেন করা হয়েছে। আধুনিক ড্রেন করা হয়েছে মিরপুরের কিছু এলাকায়। উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরে কাজ চলমান। তবে অন্য এলাকায় তেমন কোনো কাজ হয়নি। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ চলায় বিমানবন্দর সড়কের আর্মি স্টেডিয়াম থেকে কাকলী পর্যন্ত থাকা প্রাকৃতিক জলাধার মাটি ফেলে সম্পূর্ণ ভরাট করে ফেলা হয়েছে। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই ওই এলাকা জলাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। সবচেয়ে বড় আশঙ্কার বিষয় হলো, কুড়িল থেকে পূর্বাচল খাল খননের কাজ এখনো শেষ হয়নি। ফলে কুড়িল এলাকার পানি খালে প্রবেশের কোনো প্রশস্ত চ্যানেল নেই। ভারী বৃষ্টিপাত হলে ওই এলাকাও ডুববে। আর ইতোমধ্যে সেই নমুনা পাওয়া গেছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম শরিফ উদ্দিন বলেন, বর্তমান মেয়র জলাবদ্ধতার বিষয়ে সচেতন। ডিএনসিসির পক্ষ থেকে জলাবদ্ধতা নিরসনের যাবতীয় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে খালগুলো পরিষ্কার রাখা খুবই প্রয়োজন। আর উন্মুক্ত ড্রেন দিয়ে পানি যাতে স্টর্ম স্যুয়ারেজে প্রবেশ করতে পারে, সেটা দেখার দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো: আসাদুজ্জামান বলেন, মতিঝিল, আরামবাগ, সেগুনবাগিচা, কাকরাইলসহ আশপাশের ১০ দশমিক ৯২ বর্গকিলোমিটার এলাকার পানি টিটিপাড়া পাম্প হাউজ দিয়ে মানিকনগর খালে পড়ে। সেখানে তিনটি পাম্প রয়েছে। কিন্তু ভারী বৃষ্টিপাতের সময় এই পাম্প দিয়েও পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা সম্ভব নয়। এ ছাড়া শাজাহানপুর খালে একটি পাম্প হাউজ স্থাপন করা প্রয়োজন। কিন্তু ওয়াসা পাম্পের সক্ষমতা বাড়ায়নি। পাম্পের সংখ্যা না বাড়ালে জলাবদ্ধতার নিরসন হবে না। এ ছাড়াও বর্ষাকালে ঢাকার আশপাশের পানির স্তর শহরের চেয়ে উঁচু হয়ে যায়। তখন পানি নিষ্কাশনও কঠিন হয়ে পড়ে।
রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিয়ে গবেষণা করা বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন সিপ ইন্টারন্যাশনালের ‘জার্নি টু ওয়ার্ডস ডিসাস্টার রেজিস্ট্যান্ট ঢাকা সিটি’ প্রকল্পের সমন্বয়ক সাইফুন নাহার জানিয়েছেন, রাজধানীর জলাবদ্ধতার মতো বড় সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে যেভাবে সিটি করপোরেশন এবং ওয়াসাকে যৌথভাবে প্রকল্প গ্রহণ করতে হয়, এখনো পর্যন্ত সেটা করা হয়নি। সিটি করপোরেশনের কাছে জানতে চাইলে তারা বলে জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। ওয়াসার কাছে জানতে চাইলে তারা বলে সিটি করপোরেশন দেখবে। এমন অবস্থার মধ্যে প্রতি বছর বর্ষা মওসুম এলেই ভোগান্তিতে পড়ছেন নগরবাসী।
ওয়াসার অভিযোগ, ‘সিটি করপোরেশন উন্মুক্ত ড্রেনগুলো পরিষ্কার রাখে না। আর সিটি করপোরেশন বলে, ওয়াসা বক্স কালভার্ট ও স্টর্ম স্যুয়ারেজ ড্রেন পরিষ্কার রাখে না। পরিষ্কারের নামে প্রকৌশলী-ঠিকাদারেরা টাকা লুটে নেয়। এই পাল্টাপাল্টি অভিযোগের একপর্যায়ে ২০১৭ সালের বর্ষা মওসুমে ঢাকার দুই মেয়র আনিসুল হক ও সাঈদ খোকন ওয়াসাকে তীব্রভাবে কটাক্ষ করেন। ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে সিটি করপোরেশনের হাতে ন্যস্ত করার কথা বলেন। যদিও সিটি করপোরেশন ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে পঙ্গু সন্তানের সাথে তুলনা করে তা নিতে অস্বীকার করে।
১৯৯৬ সালের পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইনের ১৭ ধারায় বলা আছে, ঢাকা ওয়াসা পানি নিষ্কাশনের জন্য বড় ড্রেন নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও খাল দেখভাল করবে। অন্য দিকে, সিটি করপোরেশন আইন ২০০৯-এর তৃতীয় তফসিলে বলা হয়েছে, ছোটখাটো নালা, ড্রেন নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে সিটি করপোরেশন। এই আইনের সুযোগে তারা পরস্পরের ওপর দোষ চাপিয়ে যাচ্ছে।
রাজধানীতে প্রায় ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার স্টর্ম স্যুয়ারেজ লাইন। এ দুটি মাধ্যমেই বৃষ্টির পানি বিভিন্ন জলাশয়, খাল বা নদীতে পড়ে। এগুলো দেখভাল করে ঢাকা ওয়াসা। এ ছাড়া ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের রয়েছে দুই হাজার ৫১ কিলোমিটার উন্মুক্ত (সারফেস) ড্রেন। মূলত বৃষ্টির পানি ওই সারফেস ড্রেন দিয়ে বক্স কালভার্ট বা স্টর্ম স্যুয়ারেজ লাইনে প্রবেশ করে। স্টর্ম স্যুয়ারেজ লাইন বা বক্স কালভার্ট দিয়ে সরাসরি সেই পানি নিচু জলাশয়ে গিয়ে জমা হয়। কিন্তু বিভিন্ন জটিলতার কারণে এবারো অবস্থা বিগত বছরের মতো হওয়ার আশঙ্কা। পানি নিষ্কাশনের জন্য ওয়াসার ড্রেনেজ সার্কেলের যে শ’ দেড়েক জনবল রয়েছে, তারাও বসে বসে বেতন নিচ্ছেন। এদিকে বক্স কালভার্টের ভেতরটা ইতোমধ্যে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে পানি নিষ্কাশিত হতে পারছে না।
জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যর্থ হলেও ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান কিছু দিন আগে জানান, জলজট নিরসনে কিছু পদক্ষেপ তিনি নিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে আছে ১৭টি খালের ৩০ কিলোমিটার খাল পুনঃখনন, ৩০০ কিলোমিটার স্টর্ম ওয়াটার পাইপ ড্রেন পরিষ্কার-মেরামত, ৭০০টি ক্যাচপিট নির্মাণ ও আধুনিকায়ন, ১২টি ম্যানহোল নির্মাণ, সেগুনবাগিচা বক্স কালভার্টের ময়লা অপসারণ, চারটি স্থায়ী পাম্প রক্ষণাবেক্ষণ ও ১৫টি অস্থায়ী পাম্প স্থাপন। ফলে ভারী বৃষ্টিপাত হলেও জলাবদ্ধতা হবে না। কিছু সময় পরই পানি নেমে যাবে। আর জলাবদ্ধতা নয়, কিছুটা জলজট হতে পারে। কিন্তু গত শুক্রবারই নগরবাসী সেই জলাবদ্ধতার শিকারে পরিণত হন।
বিদ্যমান ড্রেনেজ ব্যবস্থায় ঘণ্টায় ৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলে সেই পানি সরতে সময় লাগবে তিন ঘণ্টা। ৫০ মিলিমিটার হলে চার ঘণ্টা। তবে ৭০ মিলিমিটার হলে লাগবে অন্তত ১০ ঘণ্টা। ভরা বর্ষা মওসুমে ঘণ্টায় ৭০ মিলিমিটারের অধিক বৃষ্টিপাত হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। কাজেই তখন ১০ ঘণ্টার জলাবদ্ধতা তৈরি হবে নগরীতে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ঘণ্টায় ৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত না হলেও অনেক স্থানেই ব্যাপক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement