১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঝুঁকিপূর্ণ শহর ঢাকা

-

প্রতিটি নগরেরই বৈশ্বিক মানদণ্ড থাকে। ঢাকা শহরে সেই মানদণ্ডের কিছুই নেই। যে সংস্থার যে দায়িত্ব তারা সেটা ঠিকমতো পালন করে না। কর্তৃপক্ষগুলোকে জবাবদিহির মধ্যে আনা হয় না। যেসব কারণে রাজধানী বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে, অপরিকল্পিত নগরায়ন সেগুলোর অন্যতম। নগরায়ন পরিকল্পনা অনুযায়ী না হওয়ায় দুর্যোগ মোকাবেলায় যেসব অনুষঙ্গ নিশ্চিত করা প্রয়োজন, ভবনগুলোতে সেগুলো নেই বললেই চলে।
রাজধানীতে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ঝরে যাচ্ছে বহু প্রাণ। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে রাষ্ট্রের মূল্যবান সম্পদ। পুরান ঢাকা থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকার ভবনগুলোও বাদ পড়ছে না আগুনের হাত থেকে। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে পুরো ঢাকা যেন অগ্নিগর্ভে পরিণত হয়েছে। ঢাকায় কোনো ট্র্যাজেডির পর কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও সেগুলো বাস্তবায়ন হয় না। গড়ে ওঠা অবকাঠামোগুলোর পর্যবেক্ষণেও যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা লক্ষণীয়। ফলে সার্বিকভাবে রাজধানীতে অগ্নিঝুঁকির মাত্রা বেড়েই চলছে। চকবাজারের চুড়িহাট্টা, বনানীর এফ আর টাওয়ার, গুলশান ডিএনসিসি মার্কেট ও সর্বশেষ খিলগাঁওয়ের মিউনিসিপ্যাল সুপার মার্কেটের অগ্নিকাণ্ড এসবেরই প্রামাণ্য উদাহরণ।
সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে একটি ভবনে যেসব অগ্নিনিরাপত্তা সামগ্রী থাকা প্রয়োজন, নির্মাণ কাঠামো যেমন হওয়া প্রয়োজনÑ সেসবের অভাব রয়েছে। ভবনটি যে কাজে ব্যবহার হওয়ার কথা, কার্যত তা হয়নি। অনুমোদন ছাড়াই এবং ঝুঁকি বিবেচনা না করেই ভবনের তলার সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। ভবনের বাসিন্দাদের অগ্নিনির্বাপণ সম্পর্কে সম্যক ধারণাও ছিল না। ফলে হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে।
২০১৭ ও ২০১৮ সালে রাজধানীর ভবনগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে দুই হাজার ৬১২টি ভবনে জরিপ চালায় ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। জরিপে দেখা যায়, মাত্র ৭৪টি ভবনে যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রয়েছে। দুই হাজার ৪৪৮টি ভবনে অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থাই নেই এবং বাকি ৯০টি ভবনে রয়েছে অল্পস্বল্প ব্যবস্থা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অগ্নিকাণ্ডসহ যেকোনো দুর্যোগ ঝুঁকি এড়াতে একটি অবকাঠামো কিভাবে গড়ে উঠবে, সে ব্যাপারে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে (বিএনবিসি) বিস্তারিত উল্লেখ আছে। যদিও ইমারত নির্মাণ বিধিমালাটিও আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। তারপরও বিদ্যমান নিয়মগুলো অনুসরণ করে ভবন তৈরি করা হলে এবং সে অনুযায়ী অগ্নিনির্বাপক সামগ্রী থাকলে অগ্নিঝুঁকি থেকে অনেকটাই নিরাপদ থাকতে পারেন নগরবাসী। তবে এ ক্ষেত্রে ভবনের বাসিন্দাদের সচেতনতা এবং ন্যূনতম অগ্নিনির্বাপণের প্রশিক্ষণও থাকতে হবে। এর সবকিছুরই অভাব রয়েছে।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, রাজউক আওতাধীন এলাকায় ২৫ লাখ স্থাপনা রয়েছে। ছয়তলা পর্যন্ত স্থাপনা আছে ২১ লাখ ৫০ হাজার। সাততলা থেকে ২৪-২৫ তলা ভবন আছে ৮৮ হাজার। এগুলোর মধ্যে ১০ তলা এবং ১০ তলার বেশি উচ্চতাসম্পন্ন বহুতল ইমারত রয়েছে প্রায় চার হাজার। এগুলোর মধ্যে তিন হাজার ৭৭২টি ভবনই ব্যাপকভাবে অগ্নিঝুঁকিতে। ২০১৭ সালে ফায়ার সার্ভিস রাজধানীর শপিংমল, মার্কেট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, হাসপাতাল, আবাসিক হোটেল ও মিডিয়া সেন্টারসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর ওপর পরিচালিত জরিপে এই চিত্র উঠে আসে। ফায়ার সার্ভিস বলছে, এসব প্রতিষ্ঠানের অগ্নিনিরাপত্তা সংক্রান্ত ফায়ারসেফটি প্ল্যান নেই। ওই সময় তিন হাজার ৮৫৫টি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করা হয়। তখন সরকারি- বেসরকারি ৪৩৩টি হাসপাতালের মধ্যে ১৭৩টিকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও ২৪৯টিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ৩২৫টি আবাসিক হোটেলের ৭০টি ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’ এবং ২৪৮টি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ২৬টি মিডিয়া ভবনের মধ্যে মাত্র দুটির অগ্নিনিরাপত্তা প্রস্তুতি সন্তোষজনক বলে জানা যায়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, প্রতিটি নগরেরই বৈশ্বিক মানদণ্ড থাকে। ঢাকা শহরে সেই মানদণ্ডের কিছুই নেই। যে সংস্থার যে দায়িত্ব তারা সেটা ঠিকমতো পালন করে না। কর্তৃপক্ষগুলোকে জবাবদিহির মধ্যে আনা হয় না। অগ্নিদুর্ঘটনা কী কারণে ঘটছে, কার গাফিলতিতে ঘটছে, তা উদঘাটন করা গেলে এবং দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়া হলে এসব দুর্ঘটনা কিছুটা হ্রাস পেত। এখানে এই জবাবদিহির বড় অভাব।
বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল ল ইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন (বেলা) এর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ঢাকায় অপরিকল্পিতভাবে ভবন গড়ে তোলা হচ্ছে। ভবনগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে না। আকাশচুম্বী ভবনগুলো একটি আরেকটার গা ঘেঁষে আছে। তাই দিন দিন আগুনের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে ঢাকা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার প্রিভেনশন এবং আরবান সেফটির পরিচালক অধ্যাপক ড. তাহমিদ এম আল হুসাইন বলেন, পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকা সব জায়গাতেই অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটছে। আগুন কেন লাগে, কিভাবে ছড়ায়, তার বৈজ্ঞানিক বিশ্নেষণ করলেই কারণগুলো বেরিয়ে আসবে। রাজধানীর ভবনগুলোতে কোনো অ্যাভোকেশন প্ল্যান এবং অ্যাভোকেশন রুট নেই। ভবনগুলোতে ফায়ার অ্যালার্ম নেই। নেই ফায়ার স্টিংগুইশার। যেগুলো থাকে সেগুলোর মেয়াদ থাকে না। থাকলেও বাসিন্দারা ব্যবহার জানেন না।
রাজউকের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজউকের আর পিছু হটার কোনো সুযোগ নেই। এখন রাউজকের ২৪টা দল প্রতিদিন মাঠপর্যায়ে গিয়ে ভবনের সব ধরনের অনিয়মের তথ্য সংগ্রহ করছে। এসব রিপোর্ট পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেয়া শুরু হবে। অনিয়ম করে কোনো ভবন কেউ টিকিয়ে রাখতে পারবে না।


আরো সংবাদ



premium cement