২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

মেট্রোরেলের কাজের কারণে ঢাকাবাসীর চলার পথ এলোমেলো

-

রাজধানীতে চলাচলকারী শতাধিক সড়কপথের বাসের গতিপথ বদলে গেছে। এর ফলে অগণিত মানুষের চলার পথ এলোমেলো হয়ে গেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও নির্ধারিত স্থানে গণপরিবহনের দেখা মিলছে না। মেট্রোরেলের কারণে নতুন করে দুর্ভোগ বেড়েছে ফার্মগেট, খেজুরবাগান, তেজগাঁও, বাংলামোটরসহ আশপাশের এলাকাবাসী ও কর্মজীবী মানুষের। এই দুর্ভোগ কত দিন সইতে হবে? তারও কোনো উত্তর জানা নেই কারো। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ জানিয়েছে, মেট্রোরেল প্রকল্পের দ্বিতীয় অংশের কাজ শুরু হয়ে যাওয়ায় বাসের চলার পথ পরিবর্তন করতে হয়েছে। কত দিন এভাবে গণপরিবহন চলবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানা যায়নি।
গত ১৫ জানুয়ারি থেকে রাজধানীতে ট্রাফিক বিভাগের নতুন নিয়মে বাস চলছে। মিরপুর রোড থেকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ হয়ে আসা বাসগুলোকে ফার্মগেটের দিকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। ওই সড়কপথের বাসগুলো বিজয় সরণী থেকে তেজগাঁওয়ে দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হচ্ছে। ওই সড়কে চলাচলকারী কোনো কোনো বাস সরাসরি সায়েন্স ল্যাবরেটরি হয়ে শাহবাগ দিয়ে মতিঝিল যাচ্ছে। মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ এগোনোর সাথে সাথে আরো বাসের পথ বদলানো হবে। গণপরিবহনের চলার পথ বদলে দেয়ায় বিপত্তিতে পড়তে হচ্ছে যাত্রী ও বাসচালকদের।
প্রতিদিন মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর থেকে মতিঝিলে অফিস করেন ফয়সাল হাবিব। পেশায় তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মচারী। যাতায়াতের একমাত্র ভরসা বাস। মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজের জন্য মিরপুর ১০ নম্বর থেকে আগে ফার্মগেট হয়ে মতিঝিল গেলেও এখন ওই রুটের বাসগুলোর গতিপথ বদলে শুক্রাবাদ হয়ে এলিফ্যান্ট রোড দিয়ে মতিঝিল পৌঁছায়।
২০১৮ সালের শেষ দিকে সিপি ৫ ও ৬-এর কাজ শুরু হয়েছে। সিপি ৫-এর আওতায় আগারগাঁও থেকে সার্ক ফোয়ারা পর্যন্ত ৩ দশমিক ১৯ কিলোমিটার রুট হবে। ওই রুটে তিনটি স্টেশন থাকবে। ওই অংশে থাকবে ১০০টি পিয়ার। এসব পিয়ার নির্মাণের জন্য এরই মধ্যে আগারগাঁও থেকে সার্ক ফোয়ারা পর্যন্ত সড়কের অনেক অংশে বিভাজক তুলে ফেলা হয়েছে। বসানো হয়েছে কংক্রিটের বাউন্ডারী।
এ কারণে আট লেনের সড়ক চার লেন হয়ে গেছে। এই চার লেনের সড়ক দিয়ে প্রায় দুই বছর যান চলাচল করবে। একইভাবে সার্ক ফোয়ারা থেকে মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত সড়কে সিপি ৬-এর কাজও শুরু হয়েছে। প্রকল্পের কাজের জন্য সরু হয়ে গেছে সড়ক। আট লেনের প্রধান সড়ক কমে হয়ে গেছে চার লেনে। কোথাও কোথাও এর চেয়েও সরু হয়ে গেছে বা যেতে পারে রাজপথ।
উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৩৭৭টি পিয়ারের ওপর ৩৭৬টি স্প্যান বসে বিস্তৃত হবে ২০ কিলোমিটারের মেট্রোরেল প্রকল্প। কন্ট্রাক্ট প্যাকেজ (সিপি)-৩, ৪, ৫, ৬ এই চারটি প্যাকেজের কাজ পুরোদমে চলছে। এর মধ্য প্রথম ভাগে প্রায় ১২ কিলোমিটার অংশে রয়েছে আগারগাঁও পর্যন্ত। প্রকল্পের ওই অংশের কাজ অনেকটাই এগিয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু করতে পারবেন বলে আশা করছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। আর পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২২ সালে।
ট্রাফিক বিভাগ জানিয়েছে, আগারগাঁও-ফার্মগেট থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সড়কটি প্রস্থে প্রায় ২২ মিটার। এর মধ্যে সড়কের দুই পাশের মধ্যবর্তী ১১ মিটার অংশে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ চলবে। তাই একপাশের মাত্র সাড়ে পাঁচ মিটারের মধ্যে যানবাহন চলাচল করবে। ওই অংশ দিয়ে মাত্র একটি বাস অথবা প্রাইভেট কারের সাথে খুব বড়জোর একটি মোটরসাইকেল পাশাপাশি একসাথে চলতে পারবে। এ কারণে সামনে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে যানজট আরো বৃদ্ধি আশঙ্কা রয়েছে। তাই যান চলাচলে বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়া কোনো উপায় নেই বলে জানান ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা।
এ পরিস্থিতির সমাধানে ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে সরকারের উচ্চপর্যায়ে ১৫ দফা প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবে রাজধানী ঢাকায় প্রধান তিনটি সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো বিমানবন্দর-ফার্মগেট-শাহবাগ, জিরোপয়েন্ট-মতিঝিল সড়ক। দ্বিতীয়টি হলো পল্টন-বাড্ডা-বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা হয়ে বিমানবন্দর। আর তৃতীয় সড়কটি হলো গুলিস্তান-মিরপুর সড়ক।
এই তিনটি সড়কের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিমানবন্দর-মতিঝিল সড়কটি। এই সড়ক ‘ভিআইপি সড়ক’ হিসেবে পরিচিত। এই ভিআইপি সড়কই রাজধানী ঢাকাকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। ভিআইপি সড়কের কোনো অংশে যানজট সৃষ্টি হলে এর প্রভাব পড়ে পুরো রাজধানীতে। এ ছাড়া ভিআইপি সড়ক দিয়ে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা চলাচল করেন। এর পাশাপাশি এই সড়কে ১১১টি রুটের বাস যাত্রী পরিবহন করছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) এর দেয়া তথ্যানুসারে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে ঢাকায় বিআরটিএর নিবন্ধিত যানবাহন রয়েছে ১৩ লাখ সাত হাজার ৫০০টি। এর মধ্য প্রাইভেট কার রয়েছে দুই লাখ ৭৭ হাজার ১৪১টি।
ট্রাফিক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজের কারণে বাসের চলার পথ পরিবর্তন করায় বর্তমানে সার্ক ফোয়ারা অতিক্রম করছে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ৮০০ প্রাইভেট কার। তাই যানজট কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা, যাদের প্রধান বাহন বাসের মতো গণপরিবহন।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম কমিশনার (দক্ষিণ) মফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন, ১৫টি প্রস্তাব এর মধ্যে রয়েছে মেট্রোরেল প্রকল্প, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, ট্রাফিক বিভাগের মধ্যে মাঠপর্যায়ে সমন্বয় করা, যেসব এলাকায় সড়ক বেশি সরু হয়েছে সেখানে ফুটপাথ কেটে ছোট করা, বিদ্যুতের খুঁটি সরিয়ে ফেলা, পরিবেশদূষণ যেন না হয় সেদিকে লক্ষ রাখা, মেট্রোরেলের ভারী কাজগুলো সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয় করানো। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট বা মোড়গুলোতে নজরদারি করা। এর পাশাপাশি বড় কোনো কাজের আগে গণমাধ্যমের সহায়তায় নগরবাসীকে অবহিত করা।
মেট্রোরেলের মতো বড় প্রকল্পের জন্য সড়কের ১১ মিটার জায়গা প্রয়োজন হবে। এই জায়গার মধ্যে গার্ডার বসানো হবে। পুরো বিষয় নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্টদের সাথে একাধিকবার বৈঠক করেছি। সমস্যা হলো, এই সড়কের দু’পাশে অনেক ভবনে নিচে কার পার্কিং নেই। এ কারণে যানজট সৃষ্টি হয়। এসব ভবনের তালিকা তৈরি করে ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে আমরা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে দিয়েছি।
যানজট কমাতে ফার্মগেট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত সড়কে ব্যস্ত সময়ে প্রাইভেট কার বন্ধ রাখার চিন্তাভাবনা করছে ট্রাফিক বিভাগ।
বিকল্প হিসেবে ফার্মগেটের আল রাজী হাসপাতালের পাশ দিয়ে প্রাইভেট কারগুলোকে তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড়ের দিকে পাঠানো হবে। এর অংশ হিসেবে আল রাজী হাসপাতালের সামনের সড়কের বিভাজক তুলে প্রশস্ত করা হবে। নির্বিঘেœ চলাচলের জন্য এই সড়কে রিকশামুক্ত রাখা হবে। এ ছাড়া তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালের সামনে রেলক্রসিংয়ে বাঁক তুলে সড়কটি সোজা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
অন্য দিকে, যারা গুলশান বা মগবাজার দিয়ে প্রাইভেট কারে কাওরান বাজার এলাকার দিকে আসবেন, বিকল্প হিসেবে তাদের এফডিসি সড়ক দিয়ে হোটেল সোনারগাঁও মোড়ের কাছাকাছি নেমে যেতে হবে। মিরপুর বা ধানমন্ডি থেকে আসা প্রাইভেট কারের যাত্রীদের বসুন্ধরা মোড়ের কাছাকাছি নেমে যেতে হবে।
ফার্মগেট-শাহবাগ সড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে চলাচলও নিয়ন্ত্রণ করে মোটরসাইকেলকে প্রাধান্য দেয়ার চিন্তা রয়েছে।
২২ মিটারের সড়ক ১১ মিটারে নেমে আসছে। তাই সরু সড়কে মোটরসাইকেল ও বাস চলাচল করলে সাধারণ মানুষের উপকারে আসবে। রাজধানীর বেশির ভাগ মানুষ এই দু’টি যানবাহনের ওপর বেশি নির্ভরশীল। তাই এগুলোর প্রাধান্য দেয়া হলে ভোগান্তি অনেকটাই কমতে পারে।
২০২০ সালের মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালুর আশা প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের। তবে আগারগাঁও-মতিঝিল রুটে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২১ সালের শেষ দিকে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আগারগাঁও-সার্ক ফোয়ারা অংশের কাজ সম্পন্ন হতে পারে। তাই কমপক্ষে দুই বছর রাজধানীর সরু সড়কে যানবাহন ও জনতার চলাচল করে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement