২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাজধানীতে বিনোদনকেন্দ্রের সঙ্কট!

-

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে নানা ব্যস্ততার মধ্যেও বিনোদনপিয়াসু মানুষ খুঁজে ফেরে একটু প্রশান্তির ছায়া। তাই তো সবাই চায় পরিবার-পরিজন নিয়ে একটু বিনোদন একটু ঘোরাঘুরি করতে। ছুটির দিনে কিংবা কাজের ফাঁকে বাইরে ঘুরতে বের হলেই পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। কারণ ঢাকায় এখন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ঘিঞ্জি ভবন, পরিবহন ও জনস্রোতের রাজত্ব চার দিকে। দুই দশক আগেও পর্যাপ্ত খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান ও পার্ক ছিল, যার বেশির ভাগই আজ বিলীন। ফলে কমেছে নগরবাসীর বিনোদনের পরিসর। রাজধানী ঢাকায় প্রতিনিয়তই বাড়ছে মানুষের সংখ্যা। সে তুলনায় বাড়ছে না নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ও বিনোদনের পরিবেশ।
রাজধানী শহর হিসেবে ঢাকা তার জনসংখ্যার দিক থেকে সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করেছে বহু বছর আগেই। এখন পৌনে দুই কোটি লোকের এই মহানগরীতে মানুষের গায়ে গা লাগার মতো দশা। ভুলে গেলে চলবে না মানুষই একমাত্র প্রাণী যার বেঁচে থাকা তথা সুস্থ থাকার জন্য শুধু খাদ্য গ্রহণ করলেই চলে না, মনের আহারও চাই তার। সেজন্য মানুষ নিজে কিছু সৃষ্টি করে, তা না হলে অন্যের সৃষ্টি উপভোগ করে। তার চাই নির্মল বিনোদন। এই আনন্দ উপভোগ আবার ঠিক ঘরে বসে পুরোপুরি লাভ করা যায় না। যদিও আধুনিক যুগ তার হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে নানা বিনোদনের অজস্র উপকরণ ও সম্ভার। তবু তার চাই ঘরের বাইরে যাওয়া, দল বেঁধে বিনোদন লাভ করা। ঢাকা মহানগরীতে মানুষের তুলনায় বিনোদনকেন্দ্রের বিরাট ঘাটতি রয়েছে। তাই হাতেগোনা কয়েকটি বিনোদনকেন্দ্রে দলে দলে মানুষ ভিড় জমায়। আর এই ভিড়ের ফলে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে আনন্দদায়ক স্থানগুলো।
একসময়ের প্রাকৃতিক পরিবেশকে ঘিরে বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা শহর ঢাকা এখন ক্রমেই হারাচ্ছে মানুষের বাসযোগ্যতা। প্রায় দুই কোটি মানুষের ভারে অচল রাজধানীতে নেই পর্যাপ্ত আনন্দ আর বিনোদনের পরিবেশ। পর্যাপ্ত খোলা স্থানের অভাবে নগরবাসীর নাভিশ্বাস পরিস্থিতি। শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গিয়েও যেন একটি পরিবেশসম্মত বিনোদনকেন্দ্র পাওয়া যায় না। পুরান ঢাকার তুলনায় শহরের অন্য অংশে উন্মুক্ত স্থান বা পার্ক-উদ্যানও তুলনামূলক কম। আর যেটুকুও রয়েছে সেখানে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ প্রবেশ করতে পারে না। আর অন্যগুলোতে অপরিছন্নতা আর নিরাপত্তাহীনতায় চলাচল করা যায় না। রাজধানী ঢাকার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অল্পবিস্তর ফাঁকা জায়গায় মূলত মানুষের বিনোদনের চাহিদাও পূরণ করে থাকে। নগরজীবনে একটু বিশুদ্ধ নির্মল বাতাসের স্বাদ নিতে মানুষ ছুটে যায় বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় তা একেবারেই অপ্রতুল। সরকারি উদ্যোগে এখন আর বিনোদনকেন্দ্র গড়ে ওঠে না বললেই চলে। অথচ বিশ্বের প্রায় সব উন্নত শহরে এলাকাভিত্তিক রয়েছে বিনোদনকেন্দ্র। রয়েছে পরিবেশবান্ধব নানা ধরনের বিনোদনের জায়গা। আর এগুলো সম্ভব হয়েছে নগর সরকারব্যবস্থা থাকার ফলে। রাজধানীর সার্বিক দেখভালের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের হাতে থাকলেও বিভিন্ন দফতরের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে না থাকায় পরিকল্পনামাফিক কাজ তারাও করতে পারে না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, উন্নত শহরে করপোরেশনের হাতে নগর পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও ওয়াসার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকে। এরপর স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে করপোরেশন সব ধরনের কাজ সম্পন্ন করে। ১৯৯০ সালে সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত নতুন করে কোনো পার্ক-উদ্যানের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়নি। ফলে ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানী ঢাকা শহর ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বড় আকারের উদ্যান ছাড়াও রাজধানীতে সিটি করপোরেশনের হিসাব মতে পার্ক রয়েছে ৪৭টি আর খেলার মাঠ ১০টি। কিন্তু এগুলো কাগজের সাথে বাস্তবের মিল পাওয়া যায় না। এ হিসাব অনুযায়ী পৌনে চার লাখ মানুষের জন্য একটি পার্ক। আবার এ পার্কগুলোর মধ্যেও ১৭টি বেদখলে।
এ ব্যাপারে নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব জানিয়েছেন, একটি শহরে সব ধরনের কাজ সঠিকভাবে করতে হলে ‘সিটি গভর্নমেন্ট বা নগর সরকার’ প্রয়োজন। আমরা যদি বিশ্বের উন্নত শহরগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে দেখব বিনোদনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ‘ওয়াটার বডি’ নির্মাণ। কিন্তু যেখানে আমাদের শহরের চার পাশে নদী ও খাল রয়েছে, সেখানে খুব সহজেই এ কাজটি করা যায়। কিন্তু ব্রিটিশ আমল থেকে যে পরিমাণ বিনোদনকেন্দ্র ছিল এখনো তাই রয়ে গেছে। শহরে মানুষের চাপ বাড়ার সাথে সাথে বিনোদনকেন্দ্র না বাড়িয়ে তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমানো হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী শহরের নির্দিষ্ট বাসিন্দাদের জন্য জোনভিত্তিক বিনোদনকেন্দ্র থাকা প্রয়োজন ছিল।
১৬৬০ সালে মোগল আমলে প্রতিষ্ঠিত রমনা পার্ককে ঢাকার প্রাণ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়ে থাকে। শহরের প্রাণকেন্দ্র অবস্থিত এ পার্ক রাজধানীবাসীর কাছে বিনোদন ও শরীরচর্চার জন্য উত্তম স্থান। কিন্তু এই উদ্যানে তেমন নজরদারি না থাকায় সন্ধ্যার পর নেমে আসে ভীতিকর পরিবেশ। আর ভাসমান যৌনকর্মীদের উৎপাত তো আছেই। পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ বা ভিক্টোরিয়া পার্ক, বলধা গার্ডেন আর নতুন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যান, বঙ্গভবন পার্ক, ওসমানী উদ্যান রয়েছে। দক্ষিণে জাতীয় সংসদ ভবন, পশ্চিমে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ‘গণভবন’ ও উত্তরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্র, এর মধ্যখানে অবস্থিত চন্দ্রিমা উদ্যান। সকাল থেকে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতেও থাকে চন্দ্রিমা উদ্যানের লেকের পাড়ে বিনোদনপ্রেমী মানুষের ভিড়। অনেকেই বিভিন্ন দিবসে প্রিয়জনকে নিয়ে বেড়াতে আসেন এখানে। গত ছয় বছরে বিভিন্ন অজুহাতে শুধু চন্দ্রিমা উদ্যান থেকেই প্রায় এক হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। আর নতুন কোনো গাছ লাগানোর দৃশ্য চোখে পড়েনি। রাতে এ উদ্যান ঘুটঘুটে অন্ধকারে পরিণত হয়। ফ্লাড লাইটগুলো বহু আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। চারদিকের ছোট ছোট পার্ক লাইটও চুরি হয়ে গেছে। লেক বরাবর গ্রিলের বেড়া থাকলেও তা চুরি হয়ে গেছে। শুধু প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সাথে পশ্চিম দিক বরাবর নতুন করে ফ্লাড লাইট লাগানো হয়েছে। বাগানের ভেতরে হাঁটার রাস্তাগুলো সংস্কারের অভাবে খানাখন্দে পরিণত হয়েছে। উদ্যানের মাঝখানে বড় আকারের একটি পুকুর রয়েছে; কিন্তু এর চার দিক ঝোপঝাড়ে ভরে গেছে। বছরের পর বছর কোনো সংস্কার করা হয় না। ছোট একটি ডোবা থাকলেও তা জঙ্গলে ঢেকে রয়েছে। উদ্যানের উত্তর পাশের গ্রিলের বেড়া বিভিন্ন স্থানে ভেঙে যাতায়াতের রাস্তা তৈরি করা হয়েছে।
রাজধানীর উত্তরার ‘উত্তরা কল্যাণ সমিতির উদ্যোগে’ প্রায় সব সেক্টরেই একটি করে ছোট পার্ক রাখা হয়েছে। কিন্তু এগুলোতে সবুজের সমারোহ তুলনামূলক কম। আবার শিশুদের খেলাধুলার জন্য তেমন সরঞ্জাম নেই। যেগুলো আছে তা ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ব্যক্তিমালিকানায় প্রতিষ্ঠিত পার্কগুলো সরকারি সহায়তা পেলে সেগুলো থেকে আরো সেবা পাওয়া যেত।
এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, শহরে বসবাসরত মানুষের ঘনত্ব বিবেচনা করে বিনোদনকেন্দ্র থাকা উচিত। সে তুলনায় আমাদের বিনোদনকেন্দ্র নেই। যেগুলো আছে তা-ও দক্ষ লোক দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ না করায় তা দিন দিন গুরুত্ব হারাচ্ছে। সিটি করপোরশেনের মধ্যে প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষের শহরের কেমন বিনোদনকেন্দ্র থাকা উচিত তা নিয়েও কোনো পরিকল্পনা করা সম্ভব হয়নি। ফলে সঠিক পরিকল্পনার অভাবে যেটুকু পার্ক, খেলার মাঠ, উদ্যান, উন্মুক্ত স্থান অর্থাৎ বিনোদনকেন্দ্র বলতে যা বোঝায় তা হারিয়ে যাচ্ছে।
রাজউক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঢাকা শহরের মানুষের তুলনায় বিনোদনকেন্দ্র কম। পরিকল্পনামাফিক উন্মুক্ত স্থান না পাওয়ায় আমরা নতুন করে উদ্যান বা পার্ক নির্মাণ করতে পারি না। তবে রাজউকের যেসব নতুন শহর করা হচ্ছে সেখানে আধুনিক নগর পরিকল্পনার বিষয়টি মাথায় নিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিনোদনের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ঢাকায় পর্যাপ্ত বিনোদনকেন্দ্র নেই, যা আছে তাও রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না। রাজধানীজুড়ে মানুষের তুলনায় খেলার মাঠ বা পার্ক একেবারেই অপ্রতুল। যা আছে, তা-ও দিন দিন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে। নতুন ঢাকার তুলনায় পুরান ঢাকায় একেবারেরই কম। হাতেগোনা কয়েকটি পার্ক ছাড়া সেখানে উন্মুুক্ত স্থান বা খেলার মাঠ প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম। একসময় ধানমন্ডি লেক ছিল শুধু ওই এলাকার মানুষের জন্য। কিন্তু এটি এখন পুরো শহরের চাহিদা পূরণ করে। আমরা আগে দেখেছি খেলার মাঠে গরুর হাট বসত। এখন বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। অনেক মাঠে নিয়মিত মেলাও বসে। এর ফলে আমাদের এই শহরে সবচেয়ে বেশি বিনোদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা। তারা বাসাবাড়িতে অনেকটাই আবদ্ধ থাকে। মহিলাদের জন্য পৃথক কোনো পার্ক নেই। সার্বিকভাবে আমাদের যে ক’টি পার্ক বা বিনোদনকেন্দ্র রয়েছে তা দেখভালের অভাবে দিন দিন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement