২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সামরিক অভ্যুত্থানের পাঁচ বছর

মুরসিকে সরিয়ে দেয়ার মুখথুবড়ে পড়েছে মিসরীয় সমাজ

মুরসিকে সরিয়ে দেয়ার মুখথুবড়ে পড়েছে মিসরীয় সমাজ - সংগৃহীত

পাঁচ বছর আগে এক সামরিক অভ্যুত্থানে মিসরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আল সিসির নেতৃত্বে ওই অভ্যুত্থানের আগে মুরসি মাত্র এক বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর সিসি সংবিধানকে স্থগিত করেন এবং অন্তর্বর্তী একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময় সেনাবাহিনী জানায়, সাধারণ মানুষের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তারা এ অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে।

এর আগে মুরসি তার ক্ষমতা বাড়াবেন- এমন শঙ্কা থেকে ২০১৩ সালের ৩০ জুন লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছিল।

এ ফলে মাত্র দুই বছরের মধ্যে মিসরে দুই দুইজন প্রেসিডেন্টের পতন ঘটে। এর আগে ২০১১ সালে মিসরে আরব বসন্তের ঢেউ লাগলে ৩০ বছর ধরে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা হোসনি মোবারক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এত অল্প সময়ের মধ্যে দেশটিতে দুইবার অভ্যুত্থানের প্রভাবে দেশটিতে অর্থনৈতিক সঙ্কট ও জাতির মধ্যে বিভক্তি বেড়ে যায়। পরবর্তী সময়ে ২০১৪ সালে সিসির উত্থানে মনে করা হচ্ছিল দেশটি আবারো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার মধ্যে প্রবেশ করছে। কারণ ক্ষমতা নিয়ে সিসি দেশের বেকারত্ব হ্রাস ও দীর্ঘমেয়াদী রাজস্ব আদায়সহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এর মধ্য জ্বালানি তেলের ভর্তুকি উঠিয়ে দেয়া, নতুন কিছু প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণ, সুয়েজ খালের সম্প্রসারণ ও দেশের কৃষিজমির পরিমাণ বাড়ানোর প্রচেষ্টা, ইত্যাদি ছিল উল্লেখযোগ্য।

সিসি বলেন, এসব কর্মকাণ্ড মিসরকে আরো স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলবে এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা হ্রাস পেলে মিসরের পর্যটন খাতেরও আয় বেড়ে যায়। সিসির এসব কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেন, নাগরিকদের স্বাধীনতার বিনিময়ে সাময়িক স্থিতিশীলতা এসেছে। নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ড ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডালিয়া ফাহমি ৬০ হাজার রাজনৈতিক বন্দি, ৪৩৪টি ওয়েবসাইট বন্ধ, ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করে বলেন, ওই সামরিক অভ্যুত্থানের সময় যে স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তা এখনো অনিশ্চিত রয়ে গেছে।
ফাহমি বলেন, এ মুহূর্তে প্রশ্ন হচ্ছে সিসি কি অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রতিক্রিয়া ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করতে পারবে।
এ বছরের মার্চে ৯২ শতাংশ ভোট নিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হন সিসি। অভিযোগ ওঠে, নির্বাচনের আগেই তিনি বিরোধী দলীয় নেতাদের বিভিন্ন অজুহাতে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন।

রাজনৈতিক অভিব্যক্তি
মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার কিছুদিনের মধ্যেই সেনাসমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থকদের ওপর ব্যাপক ধরপাকড়, হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন চালায়। ২০১৩ সালের আগস্টে রাবা আল আদাবিয়া স্কয়ারে সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে সহস্রাধিক মুরসি সমর্থক নিহত হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, সাম্প্রতিক ইতিহাসে এক দিনে এত বিক্ষোভকারীকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এটাই প্রথম। পরবর্তীতে এক বিচারে ব্রাদারহুডের শত শত লোককে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। চূড়ান্ত বিচারে ৭৩৯ জনকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে মৃত্যুদণ্ড আপাতত স্থগিত রয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ অন্যান্য মানবাধিকার গোষ্ঠী এ বিচারের ব্যাপক সমালোচনা করে। সিসির সরকার এরপর ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করে এবং দলটির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করে। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও যে কোনো ধরনের সমালোচককেও গ্রেফতার করা হয়। কাতারের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ফরেন সার্ভিসের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল আরিয়ান বলেন, এসব পদক্ষেপের দ্বারা সিসির সরকার এটাই বুঝিয়ে দিয়েছে যে, কোনো ভিন্নমত সহ্য করা হবে না।

আরো বেশি কর্তৃত্ববাদী
দায়িত্ব নেয়ার কয়েক মাস পর সিসি একটি আইন পাস করেন, যাতে বলা হয়, পুলিশের পূর্বানুমতি ছাড়া যে কোনো ধরনের বিক্ষোভ অবৈধ। বিশ্লেষকরা বলেন, এ আইনের মাধ্যমে তিনি বিরুদ্ধ আন্দোলনকে স্থিমিত করে দিয়ে দেশের রাজনৈতিক অবস্থাকে স্থিতিশীল প্রমাণ করেন।

লস অ্যাঞ্জেলসের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক অধ্যাপক জেমস গেলভিন বলেন, আরব বসন্তের পর অধিকাংশ মিসরিয় কেবল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চাচ্ছিল। এ অবস্থায় সিসির অভুত্থানে মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হন। এর পরপরই সিসি ক্ষমতা নিলে সৌদি ও উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে মিসরে আবারো অর্থের প্রবাহ শুরু হয়, যাতে সাময়িকভাবে হলেও দেশটিতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে আসে। গেলভিন বলেন, জামাল আবদুল নাসের থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসন চলছে সিসির অধীনে। বিরোধী সব ধরনের কর্মকাণ্ডকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং রাজনৈতিক বিরোধী সে ইসলামপন্থী হোক বা সেক্যুলার, তাকে হত্যা করা হচ্ছে অথবা গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করা হচ্ছে। গত বছরের মে মাসে পাস করা এক আইন অনুযায়ী অনেক এনজিও কার্যক্রমকে সন্ত্রাস বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। সেই সাথে তাদের সমস্ত কার্যক্রমে দেশটির নিরাপত্তাকর্মীরা নজরদারি করে থাকে।

আন্তর্জাতিক শান্তি বিষয়ক থিঙ্কট্যাঙ্ক সারাহ ইয়েরকেস বলেন, হোসনি মোবারকের যুগেও প্রতিবাদের তেমন অবকাশ ছিল না, কিন্তু সেক্ষেত্রেও পরিষ্কার একটি সীমারেখা ছিল। তারা মোবারক, ইসলাম বা নিরাপত্তাকর্মীদের সমালোচনা করতে পারত না। কিন্তু এখন কেউই আর নিরাপদ নয়। কোনো সীমারেখা না থাকায় এখন যে কেউ যে কোনো সময় আক্রান্ত হতে পারে।

আরব বসন্তের ধাক্কায় প্রথমে হোসনি মোবারক পতন ও পরে মুরসির উৎখাত করার পর স্থানীয়দের আশঙ্কা তৈরি হয়, তাদের দেশও সিরিয়া ও লিবিয়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়ে কি না। দেশটির ৩০-৪০ শতাংশ মানুষ দিনে দুই ডলার বা তার চেয়ে কম আয় করে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে খুব বেশি স্বাধীনতা এমনিতেই তাদের নেই। এর ওপর যুদি দেশে কোনো নতুন আন্দোলন শুরু হয় তাহলে লাখ লাখ লোক আর্থিক সংকটে পড়ে যাবেন এবং দেশে খুব দ্রুত দুর্ভিক্ষ নেমে আসবে।

চলমান চ্যালেঞ্জসমূহ
সিসি ক্ষমতায় আসার প্রথম দুই বছরে বড় ধরনের কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি না পড়ায় পরবর্তী সময়ে সরকার কিছু কিছু গুরুতর সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে। ২০১৬ সালে তারা এক চুক্তির মাধ্যমে সৌদি আরবের কাছে দুটি দ্বীপ হস্তান্তরের ঘোষণা দেয়। এতে বিক্ষোভ দেখা দিলে সরকার ৭১ জনকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়। ২০১৭ সালের মে মাসে মিসরের মুদ্রাস্ফীতি ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়, যা গত তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ অবস্থায় মিসরের অর্থনৈতিক সংস্কার প্ল্যানে সাহায্য করার জন্য আইএমএফ এক হাজার ২০০ কোটি ডলারের একটি বেইলআউট লোন দেয়। এ চুক্তির আওতায় সরকার মুদ্রা চালু করে এবং জ্বালানির দাম এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে।

এদিকে মিসর অভ্যন্তরীণভাবে অন্য যে আরেকটি সমস্যায় পড়েছে তা হলো সিনাইয়ে আইএসআইএস সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী ও জনগণের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সিসির সরকার সিনাইয়ের ব্যাপারে সংস্কার ও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও তাতে তেমন কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। বিশ্লেষকরা বলেন, সিসির সরকার অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর সমাধান না করে সেখানে পোড়ামাটি নীতি অনুসরন ও নিষ্ঠর হামলা চালিয়ে আসছে। মোবারকের সময় সন্ত্রাসী হামলার ক্ষেত্রে যে ধরনের হামলা হতো সিনাইয়ে জনসাধারণ ও নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে তার চেয়ে কঠোর হামলা অব্যাহত রয়েছে। এসব হামলার জবাব দিতে গিয়ে সিসির সরকার কেবল হামলাকারীদের বিরুদ্ধেই অভিযান চালায়নি না উপরন্তু বিরোধী পক্ষের নেতাসহ অন্যদের ওপরও হামলা চালায়।

যদিও যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও ইসরাইলের সাথে বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে মনে হচ্ছে মিসর আন্তর্জাতিকভাবে অনেক এগিয়ে গেছে, কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছে, অভ্যন্তরীণভাবে পতনের মুখে রয়েছে মিসর। ফাহমি বলেন, অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা, সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপ, ইত্যাদি কারণে মিসরীয় সমাজব্যবস্থা একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement