২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কয়েকশো খৃস্টানের জীবন বাঁচালেন একজন ইমাম

নিরাপত্তার কারণে ইমাম ও তার সঙ্গীদের মুখের ছবি ঝাপসা করে দেয়া হয়েছে। - সংগৃহীত

নাইজেরিয়ার একজন ইমাম যখন তার গ্রামে শত শত ভীতসন্ত্রস্ত পরিবারকে ছুটে আসতে দেখলেন, তখন তিনি তার নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদেরকে বাঁচাতে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই পরিবারগুলো পালিয়ে আসছিলো মূলত খৃস্টান অধ্যুষিত একটি প্রতিবেশী গ্রাম থেকে।

পালিয়ে আসা এসব লোকজন জানান যে ৩০০ জনের মতো সশস্ত্র ব্যক্তি তাদের উপর শনিবার দুপুরের দিকে হামলা চালায়। সন্দেহ করা হচ্ছে, হামলাকারীরা গবাদিপশু পালক এবং তাদের বেশিরভাগই মুসলিম। গ্রামবাসীরা অভিযোগ করেন যে আক্রমণকারীরা অকস্মাৎ তাদের গ্রামের ভেতরে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে এবং বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। হামলা থেকে যারা বেঁচে যেতে সক্ষম হয়, তারা প্রতিবেশী মুসলিম-অধ্যুষিত একটি গ্রামের দিকে পালিয়ে যেতে শুরু করেন।

এই গ্রামেরই ইমাম তখন তাদেরকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন। পালিয়ে আসা লোকজনকে তিনি একটি গোপন আশ্রয়ে নিয়ে যান। ২৬২ জনকে তিনি আশ্রয় দেন তার নিজের বাড়িতে এবং গ্রামের মসজিদে। তাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।

খৃস্টানদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসা সেই ইমাম বলেন, ‘প্রথমে আমি নারীদেরকে লুকিয়ে রাখার জন্যে আমার নিজের বাড়িতে নিয়ে যাই। তারপর পুরুষদের নিয়ে যাই মসজিদে।’

আন্তর্জাকিত সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ইমামের নাম প্রকাশ করা হয়নি এবং ছবিতে তার ও গ্রামবাসীদের মুখ ঝাপসা করে দেয়া হয়েছে।

নাইজেরিয়ার মধ্যাঞ্চলে প্রায়শই এধরনের হামলার ঘটনা ঘটে যেখানে যাযাবর পশুপালকরা স্থানীয় লোকজনের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। মূলত জমিজমা কিম্বা চারণভূমি দখল করা নিয়েই এই সংঘর্ষ ঘটে। একই সাথে এই অঞ্চলে দুটো গোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মীয় উত্তেজনারও সৃষ্টি হয়। পশুপালকরা জাতিগতভাবে ফুলানি গোষ্ঠীর, তাদের বেশিরভাগই মুসলিম আর অন্যদিকে খৃস্টানরা বেরম জাতিগোষ্ঠীর।

এই অঞ্চলে এবছরেই জাতিগত সহিংসতায় শত শত লোক নিহত হয়েছে। এক গ্রুপের হামলা, তারপর প্রতিপক্ষ গ্রুপের প্রতিশোধ।এধরনের পাল্টাপাল্টি আক্রমণের ঘটনা ঘটছে গত কয়েক বছর ধরেই। ২০১৬ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নাইজেরিয়ায় জঙ্গি গোষ্ঠি বোকো হারামের হাতে যতো মানুষ নিহত হয়েছে, তার চেয়েও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে গবাদিপশুর চারণভূমি দখলের লড়াইয়ের কারণে।

গ্রামের ওই ইমাম যদি তখন পালিয়ে আসা খৃস্টানদের বাঁচাতে এগিয়ে না আসতেন তাহলে আরো বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটতো। কারণ সশস্ত্র ব্যক্তিরা তখন প্রতিবেশি এই গ্রামটিতেও পালিয়ে যাওয়া লোকজনের খোঁজে তল্লাশি চালিয়েছিল।

গ্রামবাসীদের একজন বলেন, ‘প্রথমে তারা একটি গ্রামে হামলা চালায়। তখন আমরা নিরাপত্তা চৌকিগুলোর দিকে দৌড়াতে শুরু করি। কিন্তু তখন তারা সেদিকেও গুলি চালাতে শুরু করে। তখন নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরাও আমাদের মতো এদিকে ওদিকে পালাতে শুরু করে।’

আক্রমণকারীরা এখানেই থেমে যায় নি। যখন তারা জানতে পারে যে ইমাম গ্রামবাসীদেরকে একটি মসজিদের ভেতরে আশ্রয় দিয়েছেন, তখন তারা তাদেরকে মসজিদের ভেতর থেকে বের করে আনার জন্যে ইমামের কাছে দাবি জানাতে থাকে। কিন্তু মসজিদের ইমাম তখন তাদের দাবি অনুযায়ী কাজ করতে রাজি হন নি। শুধু তাই নয়, আক্রমণকারীদেরকে তিনি মসজিদের ভেতরে যাওয়ারও অনুমতি দেন নি।

গবাদি পশুপালকরা তখন ইমামের বাড়ি ও মসজিদ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকে। বাদানুবাদের এক পর্যায় ইমাম সশস্ত্র ব্যক্তিদের সামনে মাটিতে শুয়ে পড়েন। তার সঙ্গে যোগ দেন স্থানীয় আরো কয়েকজন মুসলিম। মসজিদের ইমাম তখন কান্নাকাটি করতে শুরু করেন এবং হাতজোড় করে তাদেরকে সেখান থেকে চলে যাওয়ার অনুরোধ করতে থাকেন।

এবং বিস্ময়কর হলেও, হামলাকারীরা তখন ইমামের কথা শুনে সেখান থেকে চলে যায়। কিন্তু যাওয়ার পথে তারা কাছেরই দুটো গির্জাতে আগুন ধরিয়ে চলে যায়।

পরে ওই ইমাম বলেছেন, তিনি লোকজনকে এভাবে বাঁচাতে চেয়েছেন কারণ আজ থেকে ৪০ বছরেরও বেশি সময় আগে এই এলাকার খৃস্টানরা মুসলিমদেরকে এখানে মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিল।

‘মুসলমানদেরকে তারা তাদের জমি জমা দিয়েছে, এজন্যে কোন টাকা পয়সা নেয়নি’ বলেন তিনি।

স্থানীয় আরেকজন মুসলিম নেতা বলেন, ‘তখন থেকেই আমরা এই বেরম গোষ্ঠীর লোকজনের সাথে বসবাস করছি কিন্তু শনিবারের হামলার মতো ঘটনা আমি কখনো দেখিনি।’

হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পর প্রাণে বেঁচে যাওয়া খৃস্টান গ্রামবাসীরা ইমামের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এরকম একজন বলেন, ‘তারা যখন আমাদেরকে মসজিদের ভেতরে নিয়ে গেল তারপর কেউই আমাদেরকে মসজিদ থেকে চলে যেতে বলেনি, তাদের জন্যে প্রার্থনা করতেও বলেনি। বরং তারা আমাদেরকে রাতের ও দুপুরের খাবার দিয়েছে। আমরা তাদের কাছ কৃতজ্ঞ।’

পালিয়ে আসা গ্রামবাসীরা এরপর ইমামের আশ্রয়ে আরো পাঁচদিন অবস্থান করেন। তারপর তাদেরকে একটি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।

এই ক্যাম্পে এখন ২,০০০ এরও বেশি লোক অবস্থান করছে। আর অন্যান্যরা আশ্রয় নিয়েছে তাদের আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে। নিজেদের গ্রাম থেকে পালিয়ে যারা প্রতিবেশী গ্রামের মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা এখনও তাদের নিজেদের গ্রামের বাড়িতে ফিরতে পারছেন না নিরাপত্তার অভাবে। তাদের বাড়িঘরও ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় ফুলানি গোষ্ঠীর একজন নেতা বলেছেন, ‘হামলাকারীদের অনেকেই বিদেশি। আমরা যখন তাদেরকে মসজিদের ভেতরে যেতে বারণ করতে থাকি তখন তারা কয়েকজন বয়স্ক লোককে মারধর করে।’

গ্রামের ৭০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি বলেন, ‘তারা আমার চার ছেলেমেয়েকে হত্যা করেছে। এখন আমাকে খাবার দেওয়ার মতো কেউ নেই।’

গ্রামবাসীরা জানান, বাড়িতে আগুন দেওয়ার আগে হামলাকারীরা বড়িঘরে ও দোকানপাটে লুটপাট চালায়। সেদিন রাত পর্যন্তও নিরাপত্তা বাহিনীর কোন ভূমিকা ছিল না। রাতের বেলায় সেফ হেভেন নামক সামরিক একটি টাস্ক ফোর্সের সদস্যরা এসে লোকজনকে উদ্ধার করেন যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এই সহিংসতার পর ওই এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement