২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শান্তির পথে দক্ষিণ সুদান

শান্তির পথে দক্ষিণ সুদান - সংগৃহীত

বিদ্রোহীদের সঙ্গে 'স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন দক্ষিণ সুদানের প্রেসিডেন্ট সালভা কির। ৭২ ঘণ্টা পর থেকে সেই চুক্তি কার্যকর হবে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এতে করে দীর্ঘ সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটবে।

এর আগে ২০১৪ সালের ২৩ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছিল দেশটিতে। সেবার চুক্তি করার মাত্র ২৪ ঘণ্টা পর তা কার্যকর হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। ইথিওপিয়ায় সমঝোতা আলোচনার পর বিবদমান পক্ষ দুটি এ চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল।

ওই সময় দেশটিতে এক মাস ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সংঘাতে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট সালভা কির ও তার সাবেক সহকারী রিক মাচারের মধ্যে রাজনৈতিক রেষারেষির জের ধরে ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর দেশটিতে পুরোদমে সহিংসতা শুরু হয়। সেই সঙ্গে দেখা দেয় সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড।

এবার আবারো উভয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। দক্ষিণ সুদানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আল দিরদিরি মুহামেদ আহমেদ বুধবার ঘোষণা দেন, ৭২ ঘণ্টা পর থেকে স্থায়ী শান্তিচুক্তি কার্যকর হবে, সে ব্যাপারে উভয় পক্ষ একমত হয়েছেন।

জানা গেছে উগান্ডার প্রেসিডেন্ট তাদের মধ্যে সমঝোতার ব্যাপারে আলোচনায় বসতে সহায়তা করেছেন। এখন পর্যন্ত দক্ষিণ সুদানের গৃহযুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে, ঘরছাড়া হয়েছে অন্তত ৪০ লাখ মানুষ।

এরদোগানের সুদান সফর লোহিত সাগরে প্রভাব বিস্তারের লড়াই

তুরস্ক-সুদানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নতুন মাত্রা পেয়েছে। তুরস্কের সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার পরিসর বৃদ্ধি, সুদানের সোয়াকিন দ্বীপকে পুনর্নির্মাণের জন্য তুরস্ককে লিজ দেয়া, সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে যৌথভাবে কাজ করে যাওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। সম্প্রতি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান সুদান সফর করেছেন। সুদান ও তুরস্কের মধ্যে ১৩টি দ্বিপীয় চুক্তি স্বার হয়েছে। কৌশলগত সহযোগিতাবিষয়ক একটি কাউন্সিল গঠনে ঐকমত্য হয়েছে। 

১৯৫৬ সালে সুদান স্বাধীন হওয়ার পর তুরস্কের কোনো রাষ্ট্রনেতা এবারই প্রথম সে দেশ সফরে যান। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ফার্স্ট লেডি এমিলি এরদোগান আর তুরস্কের সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল হুলুসি আকারকে নিয়ে এরদোগানের সুদান সফরের পর থেকেই উত্তেজনা বাড়ছে লোহিত সাগর এলাকায়। সম্প্রতি পূর্ব আফ্রিকার দেশ ইরিত্রিয়ার সাথে পূর্ব দিকের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে কাসাল্লায় বাড়তি সেনা মোতায়েন করেছে দেশটি সুদান। অপর দিকে, মিসর সেনা মোতায়েন করেছে আসমারা সীমান্তে। মিসর ইরিত্রিয়া সীমান্তে সৈন্য বাড়ানোর পর কায়রো থেকে রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করেছে খার্তুম। অর্থাৎ এরদোগানের সুদান সফরে মিসর-সুদান সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। সৌদি আরব-সংযুক্ত আরব আমিরাত-মিসর জোটের সামরিক তৎপরতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অবশ্য সৌদি আরবে নিযুক্ত সুদানের রাষ্ট্রদূত বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, সুয়াকিন দ্বীপ স্থায়ীভাবে তুরস্ককে দেয়া হয়নি। সংস্কার শেষে এটির দায়িত্ব খার্তুমকে বুঝিয়ে দেবে আঙ্কারা।

সুদান সফরে এরদোগান বলেছিলেন, ‘আমরা সুয়াকিন দ্বীপটিকে নতুন করে সাজাতে চাই। তুরস্কের একমাত্র পরিকল্পনা হচ্ছে এ অঞ্চলে অটোমান আমলের ধ্বংসাবশেষের পুনঃস্থাপন করা। উসমানীয় খেলাফতের অধীনে থাকা গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরীটিকে ধ্বংস করে দিয়েছিল পশ্চিমা দখলদাররা।

সুয়াকিনকে তার পুরনো ঐতিহ্যের আলোকে সাজিয়ে তুললে সুদান অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। কারণ প্রতি বছর এই দ্বীপ সফরে আসার সম্ভাবনা আছে কয়েক লাখ তুর্কি নাগরিকের। ঐতিহাসিক এ এলাকা সফরের মাধ্যমে তরুণদের মধ্যে ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ জন্মাবে।’ তুরস্কের অনুরোধের সাথে সাথে সাড়া দিয়ে কৃষ্ণ সাগর ও লোহিত সাগরের মধ্যবর্তী জায়গায় অবস্থিত দ্বীপ সুয়াকিন তুরস্ককে দিয়ে দিতে রাজি হয়েছে সুদান। ভৌগোলিক কারণে সামরিক ও বাণিজ্যিক দিক থেকে বহু শতাব্দী ধরে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত দ্বীপটি তুরস্ককে দিয়ে সৌদি আরব ও মিসরের চোখ রাঙানির মুখে পড়েছে সুদান। লোহিত সাগরে সুদান ও মিসরের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ এলাকার কাছের এ দ্বীপে মিসরের বর্তমান সময়ের অন্যতম ‘শত্রু রাষ্ট্র’ তুরস্কের উপস্থিতি সিসি সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। অন্য দিকে, দ্বীপটি সৌদি আরবের ঠিক উল্টো দিকে অবস্থিত হওয়ায় তুরস্কের উপস্থিতিতে রিয়াদের নানা হিসেব-নিকাশ চলছে।
সুদানের দাবি, তুরস্ক দ্বীপটির অবকাঠামো নতুন করে নির্মাণ করে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলবে।

তুরস্ক দ্বীপটির অবকাঠামো নতুন করে নির্মাণ করে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলবে। দ্বীপটির সোজাসুজি লোহিত সাগরের অপর পাড়ে অবস্থিত সৌদি আরবের মক্কা নগরী। তাই সেখান থেকে আফ্রিকার হজযাত্রীদের মক্কায় যাতায়াতে লোহিত সাগর পাড়ি দেয়ার জন্য ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবেও গড়ে তুলবে। অন্য দিকে, মিসরের দাবিÑ সুদানের কাছ থেকে লোহিত সাগর নিয়ে সেখানে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করবে তুরস্ক। আরব গণমাধ্যমগুলো খবর প্রচার করে, ‘সুয়াকিন দ্বীপের পূর্ণ মালিকানা এখন তুরস্কের হাতে। আফ্রিকা মহাদেশে তুরস্কের লোভের শেষ নেই।’ তুরস্কের সেনা সূত্র অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। 

তুরস্ক ও সুদানের মধ্যে সম্পর্ক দিন দিন ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। বর্তমানে তুরস্ক-সুদানের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার। সুদানে দ্বিপীয় বাণিজ্য ১০ বিলিয়নে উন্নীত করতে চায় তুরস্ক। সুদান সফরে এসে দেশটির প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশিরের সাথে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এরদোগান বলেন, ‘দুই মুসলিম দেশ প্রাথমিকভাবে বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার ল্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। পরে এটি ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হবে। 

এরদোগানের সুদান সফরকালীন যে ১৩টি চুক্তি সই হয়েছে। এসব চুক্তি হচ্ছে প্রতিরা, খনিজ, কৃষি, বনায়ন, বিজ্ঞান, শিা, পর্যটন, পরিবেশ ও শপিংমল ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানবিষয়ক সহযোগিতা বিষয়ে। সফরে এরদোগান সুদানি প্রেসিডেন্টের সাথে জেরুসালেম ইস্যু নিয়েও বিশেষ আলোচনা করেন। এরদোগান বলেন, ‘জেরুসালেম একটি মানবিক ইস্যু। আমরা ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখব।

জাতিসঙ্ঘকেও জেরুসালেম ইস্যুতে পর্যবেণ অব্যাহত রাখতে হবে।’ উসমানীয় খেলাফত বা অটোমান সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক স্থান পূর্ব সুদানের সুয়াকিন শহরও পরিদর্শন করেছিলেন এরদোগান। সুদানের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘যখন সারা বিশ্বে মুসলিমরা নির্যাতিত ও নিপীড়িত হচ্ছে, ঠিক এই সময়ে আমাদের ঐক্য ও সংহতির জন্য আমাদের ভাই এরদোগানের সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

তুরস্ক আগেই লোহিত সাগরে অবস্থান জোরদার করেছে। সোমালিয়ায় সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি বানিয়েছে, আর সুদানের সুয়াকিন দ্বীপেও ঘাঁটি নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। আফ্রিকার প্রাচীনতম সমুদ্র বন্দরগুলোর মধ্যে একটি সোয়াকিন দ্বীপ বন্দর। এটা আফ্রিকার মুসলমানদের সৌদি আরবের তীর্থযাত্রা জন্য ব্যবহৃত হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এর ৬০ কিলোমিটার উত্তরে পোর্ট সুদান নির্মাণ করা হলে বন্দরটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। সোয়াকিন দ্বীপ দিয়ে দেয়ার প্রতিক্রিয়ায় ৪ জানুয়ারি সুদানের প্রতিবেশী ইরিত্রিয়াতে সেনা পাঠিয়েছে মিসর। যেখানে এই সেনা মোতায়েন করা হয় সেটি মূলত আরব আমিরাতের একটি সামরিক ঘাঁটি।

হালায়েব দ্বীপের মালিকানা নিয়ে সুদান ও মিসরের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। দ্বীপটি এখন মিসরের দখলে রয়েছে। সৌদি আরব একসময় দ্বীপটি সুদানের বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল। মিসরের মতো সুদানে তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধি মেনে নিতে পারছে না ইরিত্রিয়াও। দুই পাশের এই দেশ দু’টির সাথে সুদানের সম্পর্ক অনেক দিন ধরেই শীতল। তবে ইরিত্রিয়ায় মিসরের সেনা মোতায়েনকে ইতিবাচকভাবে নিতে পারছে না সুদানের আরেক প্রতিবেশী দেশ ইথিওপিয়া। ফলে অঞ্চলটির রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ দেখা দিয়েছে।

জেনারেল সিসি সরকার জিবুতি ও সোমালিয়ায় ২০ থেকে ৩০ হাজার সৈন্যের ঘাঁটি বানানোর জন্য দেন দরবার করে যাচ্ছে। এটা ইথিওপিয়ার জন্যও শঙ্কার খবর কারণ নীলনদে বাঁধ নির্মাণ নিয়ে মিসরের সাথে দেশটির বিরোধ চলছে। ইথিওপিয়া এখন তুরস্কের সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। সোমালিয়া ও সুদানের পর ভবিষ্যতে ইথিওপিয়াতেও কি কোনো তুর্কি ঘাঁটি গড়ে উঠতে পারে এমন প্রশ্ন উঠেছে।

তুরস্কের এসব ঘাঁটি নির্মাণ সৌদি-আমিরাত আর ইসরাইলের দুশ্চিন্তার কারণ। অন্য দিকে, নীলনদের পানি ব্যবহার করাকে কেন্দ্র করে মিসর, সুদান ও ইথিওপিয়ার মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাঁধ প্রকল্প নিয়ে মিসরের সাথে সুদান ও ইথিওপিয়ার মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। গত অক্টোবরে সোমালিয়ায় ঘাঁটি স্থাপন করে সেই বহরে যোগ দিয়েছে তুরস্ক। আর সুয়াকিনে ঘাঁটি নির্মাণ হলে সেটি হবে লোহিত সাগরে তাদের দ্বিতীয় ঘাঁটি। 

তুরস্কের সাথে সুদানের সামরিক বন্ধনে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন মিসর। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বেসামরিক ও সামরিক জাহাজ মেরামতসহ লোহিত সাগরে দুই দেশের যৌথ নৌ সুবিধা। সুদান-তুরস্ক সম্পর্কে মিসর কতটা ক্ষুব্ধ দেশটির সরকার সমর্থক সংবাদপত্র ‘আল ওয়াতান’-এর কলামিস্ট এমাদ আদিব ‘ওমর বশিরের রাজনৈতিক আত্মহত্যা’ শীর্ষক কলামে লিখেছেন, ‘ডলারের বিনিময়ে সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর বশির আগুন নিয়ে খেলা করছে’।

আঞ্চলিক বিরোধ থেকে বশির ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে বলে তিনি ইঙ্গিত করেন। সুদান ইতিহাস ও ভৌগোলিক নিয়ম লঙ্ঘনের পাশাপাশি তুর্কি উন্মাদনা ও ইরানি ষড়যন্ত্রের ছত্রছায়ায় মিসরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এ ছাড়াও মিসরকে নীল নদের পানি না দেয়ার ইথিওপিয়ান পরিকল্পনা ও মিসরের পতনসাধনে কাতারের প্রচেষ্টায় সুদান প্রকাশ্যে যোগ দিয়েছে।

লোহিত সাগরের এক পাড়ে সৌদি আরব ও ইয়েমেন অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্য ও আরব বিশ্ব। আর অন্য পাড়ে উত্তর আফ্রিকার দেশ মিসর, সুদান, ইরিত্রিয়া, জিবুতি ও সোমালিয়াসহ আফ্রিকা মহাদেশ। তেল পরিবহনে লোহিত সাগর বিশ্বের ব্যস্ততম প্রবেশ পথগুলোর একটি। লোহিত সাগরের বাণিজ্যিক গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। আফ্রিকাকে কেন্দ্র করেই তুরস্ক তার কৌশল সাজাচ্ছে।

লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত আফ্রিকার আরেক দেশ জিবুতিতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও চীনের সামরিক বেইস। ফলে গুরুত্বপূর্ণ লোহিত সাগরে তুরস্কের নয়া তৎপরতা লোহিত সাগরে উত্তেজনার পারদ কতদূর নিয়ে যাবে তা দেখতে আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement