১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘স্বামী না কি ভিডিওটা করিয়েছেন’

-

মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের বৃহৎ শ্রমবাজার সৌদি আরবে প্রতিনিয়ত নারীশ্রমিকরা গৃহকর্তা ও তার পরিবারের সদস্যদের হাতে শারীরিক, মানসিক আবার কখনো যৌন নির্যাতনেরও শিকার হচ্ছেন। তাদের অভিযোগ, নির্মম নির্যাতন থেকে বাঁচতে তারা কৌশলে পালিয়ে দেশে ফেরার আগে শেষ ঠিকানা হিসেবে বাংলাদেশ দূতাবাসের আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে উঠছেন। এরপর সেখান থেকে সৌদি সরকারের দেয়া ফ্রি টিকিট ইস্যুর পরই বিভিন্ন ফ্লাইটে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।

প্রায়ই দেশটি থেকে বাংলাদেশী নারীশ্রমিকরা দেশে ফিরলেও এবারই প্রথম সুমি আক্তার নামের একজন নারী গৃহকর্মী ফেসবুক লাইভে এসে তার নিজের জীবন বাঁচানোর আকুতি জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারপ্রধানের কাছে সাহায্য চান। তার সেই আকুতি মুহূর্তে ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। এর পরই তাকে দ্রুত দেশে ফেরাতে উদ্যোগ নেয়া হয়। সৌদির জেদ্দা কনসাল জেনারেল অফিস সুমি আক্তারকে খুঁজে বের করে দেশে ফেরাতে প্রথমে সৌদি লেবার কোর্টে মামলা করেন। কফিলের ২২ হাজার রিয়াল দাবির আবেদন শ্রম আদালতে প্রত্যাখ্যাত হলে জেদ্দা অফিস সুমির ফাইনাল এক্সিট নিয়ে তাকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে।

এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল শুক্রবার সকাল সোয়া ৭টায় এয়ার অ্যারাবিয়ার একটি ফ্লাইটে সুমি আক্তার ওরফে ‘ভাইরাল সুমি’ হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। আলোচিত এই নারীশ্রমিককে নিতে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ বোর্ডের কর্মকর্র্তারা। সাথে ছিলেন সুমির স্বামী, বাবাসহ নিকটাত্মীয় ও মিডিয়াকর্মীরা। কিন্তু বিমানবন্দর প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সুমির ইমিগ্রেশন সম্পন্নের পরই গণমাধ্যমকর্মীদের ফাঁকি দিয়ে অন্য একটি গেট দিয়ে বের করে সুমিকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।

এর আগে বিমানবন্দরে অপেক্ষায় থাকা সুমির স্বামী নুরুল ইসলাম সাংবাদিকদের কাছে বলেন, সুমি দেশে ফেরায় আমার খুব আনন্দ লাগছে, তেমনি কষ্টও লাগছে। কারণ ভাগ্যবদলের আশায় সৌদি আরবে গিয়েছিল সুমি, এখন সে ফিরেছে খালি হাতে। সব কিছুর পরও সে দেশে ফিরে এসেছে, এটাই কথা। এর জন্য তিনি সরকারকে অশেষ ধন্যবাদ জানান। জানা গেছে, সুমি আক্তারের গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড় জেলার বোদা সদর থানায়। তার বাবার নাম রফিকুল ইসলাম। দুই বছর আগে আশুলিয়ার চারাবাগের নুরুল ইসলামের সাথে তার বিয়ে হয়েছিল। সম্প্রতি ফেসবুকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার সাথে সৌদি আরবে ঘটে যাওয়া পাশবিক নির্যাতনের কথা বলে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানান সুমি আক্তার। পরবর্তীতে তার ওই ভিডিওটি ভাইরাল হয়।

ভিডিওটিতে সুমি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি আমার সন্তান ও পরিবারের কাছে ফিরতে চাই। আমাকে আমার পরিবারের কাছে নিয়ে যান। এখানে আমার ওপর অনেক নির্যাতন হয়। আর কিছু দিন থাকলে হয়তো মরেই যাবো। তাই প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে অনুরোধ আপনারা আমাকে উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যান।’ সংবাদমাধ্যমে এমন খবর প্রকাশ হওয়ার পর সুমিকে দেশে ফিরিয়ে আনতে তৎপরতা শুরু হয়। গত ৪ নভেম্বর রাতে সুমিকে সৌদি আরবের জেদ্দার দক্ষিণ-দক্ষিণে নাজরান এলাকার কর্মস্থল থেকে উদ্ধার করে প্রথমে থানা হেফাজতে নেয়া হয়। পুলিশের তত্ত্বাবধানে নাজরান শহরের একটি সেইফ হোমে তাকে রাখা হয়। জেদ্দা শ্রম আদালতে এ নিয়ে মামলা নিষ্পত্তির পর সুমি আক্তারকে দেশে পাঠাতে দেশটির সরকার ফাইনাল এক্সিট দেয়। এর পরই তিনি দেশে ফিরে আসেন।

গতকাল শুক্রবার জেদ্দা অফিসের কাউন্সিলর (শ্রম) মো: আমিনুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, সুমি আক্তারের (কফিল) নিয়োগকর্তা নাজরান পুলিশের কাছে দাবি করে ছিলেন সুমিকে তার এ দেশে আনতে ২২ হাজার রিয়াল খরচ হয়েছে। তাকে এই রিয়াল ফেরত দিতে হবে। তার এ দাবির বিষয়ে আমরা ঢাকায় বিএমইটিকে লিখিতভাবে জানানোর পাশাপাশি সৌদি শ্রম আদালতেও মামলা করি। আদালত আমাদের পক্ষে রায় দেয়। এর পরই তাকে দেশে পাঠাতে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করি।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সৌদি আরবে শরিয়াহ আইন অনুযায়ী যেকোনো নির্যাতন অপরাধ। তখন সুমি তাকে দ্রুত দেশে পাঠানোর অনুরোধ জানান। তার ওপর কী ধরনের নির্যাতন চালানো হয়েছিল এ বিষয়টি তার কাছে আমরা জানতে চাইলে তখন সুমি আমাদেরকে জানিয়েছেন, ‘তাকে তার কফিল কোনো নির্যাতন করেনি। একপর্যায়ে সুমি তাদের কাছেও বলেন, তার স্বামী না কি ভিডিওটা তাকে দিয়ে করিয়েছেন, কারণ এভাবে ভিডিও করলে সে দ্রুত দেশে ফিরে যেতে পারবে বলে তার স্বামী তাকে বলেছিল।’ এর পরই সে ফেসবুক লাইভে এসে এই ভিডিওটি করেছে।

উল্লেখ্য, গত ২৫ আগস্ট ‘রূপসী বাংলা ওভারসিজ’ নামের একটি এজেন্সি থেকে সুমিকে সৌদি আরবে পাঠানো হয়েছিল। তিন মাস না যেতেই সুমি নির্যাতনের অভিযোগ এনে ফেসবুক লাইভে তার দুঃখকষ্টের কথা প্রকাশ করেন।

গতকাল রাতে বিমানবন্দর প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক তানভীর হাসান নয়া দিগন্তকে বলেন, বিমানবন্দরে একটি গ্রুপ বসে থেকে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। সৌদি আরব থেকে সুমির সাথে আরো ৯০ শ্রমিক ফিরে আসার কোনো সংবাদ না থাকলেও কে বা কারা এসব ছড়িয়ে দিচ্ছে। বাস্তবে ৯০ জন নারীশ্রমিক দেশে ফিরে আসেনি। এটি গুজব।

বাবা মায়ের কাছে হস্তান্তর
পঞ্চগড় সংবাদদাতা জানান, সৌদি আরবে নির্যাতিত নারীকর্মী সুমি আক্তারকে গতকাল শুক্রবার বিকেলে বাবা মায়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হুমায়ূন কবীর প্রধানের উপস্থিতিতে শাহজালাল রহ: আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল, বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহমুদ হাসান তাঁর বাবা রফিকুল ইসলাম ও মা মলিকা বেগমের কাছে হস্তান্তর করেন। এ সময় সুমির অন্যান্য আত্মীয়স্বজনসহ গণমাধ্যম কর্মীরা উপস্থিত ছিলন। এর আগে সকাল সোয়া ৭টায় এয়ার এরাবিয়ার একটি ফ্লাইটে সুমি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে পাঠানো হয়।


আরো সংবাদ



premium cement