২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রবীণাঙ্গন

-

পাকিস্তান আমলে মৌলভীবাজার শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বর্তমান পৌর জনমিলন কেন্দ্রটির নাম ছিল ‘জিন্না হল’। পরে নাম বদলে করা হয়েছে ‘জনমিলন কেন্দ্র’। আর বর্তমান নাম ‘পৌর জনমিলন কেন্দ্র’। একসময় মৌলভীবাজার শহরের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সভা-সমাবেশ, শিল্প-সংস্কৃতির আয়োজন, নাটক বা নৃত্যানুষ্ঠান সব ধরনের আয়োজনেই এ হলের কোনো বিকল্প ছিল না। এখনো এ হলেই শহরের প্রায় ৭০ শতাংশ অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। পাকিস্তান আমল থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রায় সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক উৎসব, রাজনৈতিক দলের সম্মেলন এখানেই হয়ে আসছে। পৌর শহরের দক্ষিণপ্রান্তে এবং জেলা জজ আদালতের উত্তরপ্রান্তে অবস্থিত এ জনমিলন কেন্দ্রটি ছোট একটা টিলার উপরে অবস্থিত। জনমিলন কেন্দ্রটির চার পাশের গাছগাছালি এর সৌন্দর্য অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে।
জেলাবাসীর কাছে অতি পরিচিত শহরের পৌর জনমিলন কেন্দ্রের সেই পরিচিত দালান ও এর আশপাশ এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। সম্পূর্ণ বদলে গেছে কেন্দ্রটির সেই পুরনো অবয়ব। জনমিলন কেন্দ্রটির সামনের অংশ থেকে পেছনের অংশ পর্যন্ত সুবিশাল এলাকাজুড়ে এখানে গড়ে তোলা হয়েছে শহরের বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকদের আড্ডা ও বিনোদনকেন্দ্র। এর নামকরণ করা হয়েছে ‘প্রবীণাঙ্গন’। প্রবীণাঙ্গন সাজানো হয়েছে আধুনিক স্থাপত্যকলায়। এটির খালি স্থানে তৈরি করা হয়েছে ফুলবাগান। ফুলবাগানে স্থান পেয়েছে দৃষ্টিনন্দন বকুল, রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া, টেকোমা, স্থলপদ্ম হাসনাহেনাসহ নানারকম মৌসুমি-স্থায়ী ও দেশী-বিদেশী জাতের ফুল।
মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র ফজলুর রহমানের উদ্যোগে পৌরসভার নিজস্ব অর্থায়নে শহরের বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকদের আড্ডা ও বিনোদনকেন্দ্র ‘প্রবীণাঙ্গন’ আধুনিক ও বিশ্বমানের উপকরণ দিয়ে সাজানো হয়েছে। গত ৩০ নভেম্বর বিকেলে প্রধান অতিথি থেকে এর উদ্বোধন করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মৌলভীবাজার-৩ (সদর-রাজনগর) আসনের সংসদ সদস্য নেছার আহমদ, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান, জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন, পুলিশ সুপার ফারুক আহমদসহ সমাজের বিশিষ্টজন। উদ্বোধনের পরপরই ‘প্রবীণাঙ্গন’ শহরের জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। এর পর থেকে প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত এবং বিকেল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত স্থানটিতে জ্যেষ্ঠ নাগরিকরা এসে হাঁটাহাঁটি করে, আড্ডা দিয়ে, বই পড়ে, খেলাধুলা করে সময় কাটাচ্ছেন। এ ছাড়া জনমিলন কেন্দ্রের তিনটি কক্ষ সংস্কার করে একটি কক্ষে পাঠাগার, একটি কক্ষে টেলিভিশন এবং একটি কক্ষ বিশ্রামের জন্য তৈরি করা হচ্ছে। পাঠাগারে স্থান পাবে সব ধরনের বই আর বিশ্রাম কক্ষে থাকবে দুটি শয্যা। জ্যেষ্ঠ নাগরিকরা হাঁটাচলা ও খেলাধুলা করে ক্লান্ত হলে বিশ্রাম কক্ষের শয্যায় বিশ্রাম নিতে পারবেন। অপর দিকে, বয়োজ্যেষ্ঠ নারীদের জন্য রয়েছে আলাদা একটি কক্ষ। এই কক্ষে নারীরা বিশ্রাম নিতে এবং আড্ডা দিতে পারবেন। পুরো প্রবীণাঙ্গনে একটু পরপর রয়েছে বসার জন্য বেঞ্চ। প্রবীণাঙ্গনে স্থাপিত তিনটি শেডেও আড্ডা দেয়া যাবে। এ ছাড়া স্থাপন করা হচ্ছে পত্রিকা ও চা-কফি কর্নার। প্রবীণাঙ্গন উন্মুক্ত করে দেয়ার পর থেকে অনেকেই তাদের নাতী-নাতনীদের সাথে নিয়ে আসছেন। প্রতিদিনই প্রবীণাঙ্গন শহরের জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের মিলনমেলায় পরিণত হচ্ছে।
মৌলভীবাজার জেলার সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের উজ্জ্বল নক্ষত্র পৌরমেয়র ফজলুর রহমান প্রবীণাঙ্গন প্রতিষ্ঠা নিয়ে বলেন, ‘আমাদের সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠরা পুরো যৌবনকাল অমানসিক পরিশ্রম করেছেন সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবারের জন্য। যখন তারা সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবারের তরে নিজেদের উৎসর্গ করেছেন, তখন তাদের নিজেদের দিকে তাকানোর সময় পর্যন্ত ছিল না। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তারা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতিতে অসামান্য অবদান রেখেছেন। প্রকৃতির নিয়মের কারণে আজ তারা বয়োবৃদ্ধ। এখন তাদের হাতে অফুরন্ত অবসর। অনেকেই ঘরে বসে আছেন। এই ঘরে বসে থাকাটা অনেকটা যন্ত্রণার মতো। বয়সের ভার, বার্ধক্যজনিত রোগব্যাধি তাদের সীমিত পরিসরে আটকে রেখেছিল। তাদের নির্মল আড্ডা স্থানটিও শঙ্কুচিত ছিল। যদিও এই বয়োবৃদ্ধকালেই তাদের আরো বেশি নিকটজনের সঙ্গ ও সব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু যান্ত্রিক জীবনে সবাই নিজ নিজ পরিসরে ব্যস্ত থাকায় সমাজের জ্যেষ্ঠ নাগরিকরা অনেকটা একাকী হয়ে পড়েছিলেন। এ বিষয়টি আমাকে ভাবায়। আমি পৌরমেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরপরই চিন্তা ছিল শহরে এমন একটি স্থান করব, যেখানে শুধু আমাদের পূর্বসূরি বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকরা আসবেন, বসবেন, হাঁটবেন, ঘুরবেন, বই পড়বেন, টেলিভিশন দেখবেন, বিশ্রাম নেবেন, নিজেদের মধ্যে ভাববিনিময় করবেন। সেই চিন্তা থেকে প্রবীণাঙ্গন তৈরি।’
গত ৫ ডিসেম্বর ‘প্রবীণাঙ্গন’ গিয়ে দেখা যায়, শহরের জ্যেষ্ঠ নাগরিকরা এখানে নির্মল আড্ডায় সময় কাটাচ্ছেন। শহরের শাহ মোস্তফা সড়কের বাসিন্দা সাবেক সরকারি কর্মকর্তা মোস্তফা শহীদ বলেন, ‘মৌলভীবাজার পৌরমেয়র ফজলুর রহমান জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের বিনোদনের জন্য যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, তা সবার হৃদয়ে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’

 


আরো সংবাদ



premium cement