২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বাস্তবতা

চারাগল্প
-

হেমন্তের বিকেল কেমন যেন! যেদিকে চোখ যায় দেখে মনে হয় সবটাজুড়ে সাদা সাদা ধোঁয়া উড়ছে। সূর্যটাও যেন খুব তাড়াতাড়ি আড়ি দিতে চায়। দেখতে দেখতে টুপ করে সন্ধ্যা নামে ব্যস্ত শহরজুড়ে। রাশেদ হাতঘড়ির দিকে তাকায়। ৫-২০ মিনিট। সন্ধ্যা নামছে চারি দিকে। দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে মাগরিবের আজান, নীড়ে ফিরছে ক্লান্ত সাদা বকের ঝাঁক।
রাশেদ বকের ঝাঁকের উড়ে যাওয়ার দিকে তাকায়। বিড়বিড় শব্দে কী যেন বলে! পরিচিত কণ্ঠ শুনে পাশ ফিরে তাকায়। সালমাকে দেখে ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ঢেউ খেলে। সালমার হাত ধরে এগিয়ে চলে আনন্দ পার্কের ভেতরে। হালকা হালকা শিশির জমে আছে পার্কের সবুজ ঘাসের ডগায়। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় যেন শিশিরকণাগুলো হাসছে! দূর থেকে দেখে যে কারো হৃদয় ছুঁয়ে যাবে! রাশেদ, সালমা হাঁটতে হাঁটতে পার্কের উত্তর দিকে এলো। আজ থেকে তিন বছর আগে ঠিক এই জায়গায় এসে প্রথম বসেছিল ওরা দু’জন। সেদিন প্রথম দেখা হয় ওদের। যদিও সম্পর্কের শুরু আরো তিন মাস আগে। সালমা তখন সবে নতুন ফেসবুক আইডি খুলেছে। দু-এক দিন পরে রাশেদকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় সালমা।
পরিচয়ের প্রথমে অন্য আট-দশটা রিলেশনের মতো ওরাও বন্ধু ছিল। সময়ের সাথে সাথে একসময় ওদের সম্পর্কেও পরিবর্তন ঘটে। প্রতিদিন সকাল, দুপুর, রাতে নিয়ম করে চ্যাটিং করা। একসময় ফোন নাম্বার আদান প্রদান। রাত জেগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে কথা বলা। ওরা দু’জন বুঝতে পারে অজান্তে দু’টি হৃদয় এক হয়েছে।
নিজেদের ভালো লাগা, খারাপ লাগা! একজন আরেকজনের কাছে না বললে যেন পেটের ভাত হজম হয় না। এমন করে তিন মাস চলার পরে একদিন দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয়। দেখা করার আগে যদিও সালমাকে ওর নিজের ছবি দেয়ার জন্য অনেক অনুনয় করেছে রাশেদ। তবে সালমা বারবার ফিরিয়ে দিয়েছে। বলেছে, প্রথম যেদিন আমাদের দেখা হবে, ওই দিন মন ভরে দেখ আমাকে। সালমাকে প্রথম দেখায় ভালো লাগে রাশেদের। প্রথম দেখা করার পরে সম্পর্ক আরো গভীর হয়।
এমন করে চলতে থাকে ভালোবাসায় মোড়ানো বছর।
দুই.
পার্কের সবুজ ঘাসে মুখোমুখি বসে আছে, রাশেদ ও সালমা। তবে কারো মুখে কোনো কথা নেই। ধোঁয়া ওড়া শিশিরকণার মতো ঝাপসা যেন, রাশেদ আর সালমার অতীত স্মৃতির পাতা।
একসময় সালমা নিজে থেকে নীরবতা ভেঙে কথা বলতে শুরু করে। রাশেদের মুখের দিকে তাকিয়ে এক নাগাড়ে কিছু কথা বলে।
শেষে রাশেদের হাতে এগিয়ে দেয় দু’টি কার্ড।
পরে কিছু না বলে পার্ক থেকে হন হন করে হেঁটে বেরিয়ে যায় সালমা। রাশেদ বোবার মতো অপলক চেয়ে থাকে, সালমার চলে যাওয়ার দিকে।
হেমন্তের শিশিরকণার মতো, অশ্রুসজল রাশেদের চোখ। সেদিকে একটুও নজর নেই রাশেদের।
সালমার দেয়া হলদ রঙের কার্ডের ভাঁজ খোলে। ভেতরে একটা চিঠি দেখতে পায়। ভাঁজ খুলে তাড়াতাড়ি করে পড়তে শুরু করে।
প্রিয় রাশেদ, তোমার সাথে তিন বছরে অনেক আনন্দময় সময় কাটিয়েছি আমি। অনেক কষ্টকর সময়ও কাটিয়েছি হাতে হাত রেখে।
তবে সবার ভালোবাসা তো পূর্ণতা পায় না।
তুমি তো জানো আমার জন্য বাবা ভালো সম্বন্ধ খুঁজছে কয়েক মাস ধরে।
মিথ্যা কথা বলে আর কতদিন বাবাকে ফাঁকি দেবো বলো? এদিকে তুমিও কোনোভাবে চাকরির ব্যবস্থা করতে পারছ না।
আর তুমি তো ভালো করে জানো, বেকার ছেলের সাথে আমার বাবা আমাকে বিয়ে দেবে না।
তোমার সাথে পালিয়ে চলে আসাটাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তোমার জন্য আমার বাবা-মায়ের মানসম্মান তো আর নষ্ট করতে পারব না।
তাই আমি বাধ্য হলাম, প্রবাসী ছেলেকে বিয়ে করতে।
প্রবাসে ছেলের বড় ব্যবসা আছে, বাড়িও আছে।
রাশেদ তুমি ভালো থেকো। নিজের প্রতি খেয়াল রেখো।
আমাকে ক্ষমা করে দিও, ইতি সালমা।
কিছুতেই চিঠির শেষের কথাগুলো ভুলতে পারে না রাশেদ। তবে বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে নিজের জীবনের অতীত ভুলতে চায় রাশেদ।
লাল, নীল রঙের কার্ডের খাম খুলে রাশেদ বুঝতে পারে সালমার বিয়ের কার্ড। আগামী শুক্রবার সালমার বিয়ে। এখন অনেক রাত, শিশিরকণার ঝাপসা ধোঁয়ায় ছুঁয়ে গেছে পার্কের সবুজ ঘাস।
ঠিকমতো চোখে দেখা যাচ্ছে না একটু দূরের কিছু।
কে জানে হয়তো এমন ধোঁয়া ওড়া শিশিরকণার মতো স্বচ্ছ জলের আয়োজনে ব্যস্ত রাশেদের হৃদয়ঘর। রাশেদ উঠে দাঁড়ায়, ধোঁয়া ওড়া শিশিরকণার পথ মাড়িয়ে এগিয়ে চলে সামনের পথে। শপথ করে, জীবনের স্বচ্ছ আলো খোঁজার।
দুর্গাপুর, কুড়িগ্রাম

 


আরো সংবাদ



premium cement