২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

হেডফোন

জীবনের বাঁকে বাঁকে
-

রৌদ্র ঘরে ঢুকেই মিনিট কয়েকের মাথায় আবার বের হয়ে যায়। বছরের শেষ দিন, আজ ব্যাংক ক্লোজিং ডে। রৌদ্র সিএ পড়ে। ব্যাংক ক্লোজিংয়ের কাজে বের হয়। অভ্র একটি হেডফোন এনে আমায় পরিয়ে দেয়, হেডফোনে আমার পছন্দের গান ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা...’ বেজে যাচ্ছে। আমি পুরাই অবাক। রৌদ্র অনেকবার বলেছে, এমন একটা হেডফোন কেনার কথা। বললেই জিজ্ঞেস করতাম,
Ñ দাম কত রে?
দাম শুনে না করে দিতাম, বলতাম,
Ñ এত দাম দিয়ে এসব কিনিস না। এমন বাড়তি খরচ প্রয়োজন নেই।
অভ্র কান থেকে হেডফোনটা খুলতে দিচ্ছে না। একের পর এক প্রিয় গান চালিয়ে দিচ্ছে আর আমি শুনছি। বেশ লাগছে, প্রিয় গান আর প্রিয় হেডফোনে। এমন একটা হেডফোনের শখ কতদিনের, অথচ কাউকে কখনো বলা হয়নি। গান আমার খুবই প্রিয়, সারা দিন গান শুনলেও খারাপ লাগবে না। যখন খুব কাজের চাপ থাকে তখনো টিভিতে বা মোবাইলে প্রিয় কিছু গান ছেড়ে দিই, গান চলতে থাকে আর আমি কাজ চালিয়ে যাই। গান শুনে কাজ করলে ক্লান্তি আসে না। প্রিয় গানের তালিকায় থাকেÑ ওরে নীল দরিয়া, পিছঢালা এই পথটাকে, আমার হিয়ার মাঝে, পুরানো সেই দিনের কথা, তোমার এক তারাতে ঘুণ ধরেছে, আমি শুনেছি সেদিন, আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, আমার মুক্তি আলোয় আলোয়, ও কি গাড়িয়াল ভাই।
অভ্র সোফায় বসিয়ে দিয়ে আমার হাতে ট্যাব ধরিয়ে দেয়। বলে, ‘আম্মু তুমি ট্যাবে লিখো আর গান শুনো, আমি একটা ছবি তুলি।’ ছবিটা দেখে মন ভরে যায়। হারিয়ে যাই সেই ২৬ বছর আগের দিনগুলোতে।
বিয়ের মাত্র দু’দিনের মাথায় শাশুড়ির সাথে চলে যাই গ্রামে, আহসান থাকে রাজধানী শহরেই। গ্রামের বাড়িতে গিয়েই একটা টেপ রেকর্ডার দেখি, আর অনেক ক্যাসেটের ফিতা। আহসান ছোট ভাই বোনদের এই টেপ রেকর্ডার কিনে দেয় গান শোনার জন্য। ক্যাসেটগুলোও আহসান কিনে আনে। বাংলা গানের কয়েকটা ক্যাসেট ছিল, তার মাঝে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি আর কুমার সানুর বাংলা গানের কয়েকটা। সকাল, দুপুর বা রাতে খুব গান শুনতাম। ছোটবেলা থেকেই গান পছন্দ, এখানে এসে প্রিয় গান পেয়ে মন ভরে যায়। পুরো একমাস থাকি গ্রামে, মনে হয় আহসানের অভাব পূরণ হয়েছে ওই টেপ রেকর্ডার দিয়েই।
এক মাস ১০ দিন থাকার পর চলে আসি কুমিল্লা জেলখানায়। অবশ্য আসামি হয়ে নয়, বড় ননদের বাসায়। সেখানে তিন মাস থাকার পর নিজেরা বাসা নিয়ে চলে আসি সাভারে। গ্রাম থেকে আসার সময় কুমার সানুর একটি ক্যাসেট নিয়ে আসি। কিন্তু কোথাও টেপ রেকর্ডার পাইনি বলে সেই ক্যাসেটের গান আর শোনা হচ্ছিল না। সাভারে আমরা যে বাসায় উঠি, দোতলা বাড়িতে চারটি ফ্লাট ছিল। চার পরিবারের মাঝে তিন পরিবার ভাড়াটিয়া, আরেক পরিবার বাড়ির মালিক। আমরা নিচতলার একটা ফ্লাটে উঠি। দোতলার এক পাশে ভাড়াটিয়া অন্য পাশে বাড়ির মালিক ছিল। দোতলার ভাড়াটিয়ার বাসায় বেড়াতে গিয়ে দেখি একটা টেপ রেকর্ডার। পরিবারের গৃহকর্ত্রীকে ভাবি বলে ডাকতাম। ভাবির কাছে শুনে নিই বাসার কে কখন বাইরে থাকে। জেনে যাই দুপুরে ভাবি ছাড়া আর কেউ বাসায় থাকে না। প্রায় প্রতিদিন দুপুরে আমি দোতলায় ভাবির বাসায় যেতাম আর সেই ক্যাসেট বাজিয়ে গান শুনতাম। আমাদের তখন কোনো রকমে সংসার চলছে। আহসানের সরকারি চাকরি হয়। বেসরকারি চাকরি ছেড়ে অল্প বেতনের সরকারি চাকরিতে আসে। বেসরকারি চাকরি ছেড়ে দেয়ার সময় কিছু টাকা পায়, তা দিয়ে ১৬ ইঞ্চির একটি প্যানাসনিক টিভি কেনা হয়। এর আগে প্রায় ৩-৪ মাস পাশের ফ্লাটে টিভি দেখেছি। টিভিটা কেনার পর কিছুটা মন ভালো হয়, প্রিয় গান না শুনলেও কিছু গান ঠিক শুনতে পেতাম।
টিভিতে দেখতাম যারা গান করে তারা কানে এমন বড় হেডফোনে গান করত, গান শুনত। আর নাটক সিনেমায় দেখতাম বড় লোকেরা অমন হেডফোনে গান শুনছে। তখন থেকেই আমি ওর নাম দিই বড় লোকের হেডফোন। নিশ্চয়ই দামও অনেক হবে। খুব ইচ্ছে হতো অমন একটা ফোন কানে লাগিয়ে ইজি কেদারা বা ঘুরানো কেদারায় বসে গান শুনি। কিন্তু এই ইচ্ছার কথা কাউকে বলিনি।
সোফায় বসে গান শুনি আর নিজের অতীত জীবনে ফিরে যাই। এখন গান শোনার তেমন কোনো সমস্যাই নেই। ঘরে ওয়াইফাই কানেকশন আছে। টিভিতে বা মোবাইলে ইচ্ছে করলেই যে কারো যে কোনো গান শুনতে পারি। প্রায় সময় দেখা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান চলছে তো চলছে আমার ঘরে, আর আমি ঘরের কাজ নিজের লেখালেখি করেই যাচ্ছি। তবে পড়ার সময় গান চালাতে পারি না। কারণ গুন গুন করে গাইতে ইচ্ছে করে। ঠিক এখন যেমন চলেছে আর আমিও গাইছি, তোমার খোলা হাওয়ায়...।


আরো সংবাদ



premium cement