২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শীতের কম্বল

চারাগল্প
-

শীত পড়ছে। হাড়কাঁপানো কনকনে শীত। বেড়ার ঘর। শীত মানছে না। বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে হু হু করে হিমেল বাতাস ঘরে ঢুকছে। তেল চিটচিটে কাঁথা বরফ হয়ে শরীরে বিঁধছে। সমিজান ঠাণ্ডায় ঠকঠক কর কাঁপছে। তার ঘুম আসছে না। সে মাকে বলে, মা, আমাকে একটু জড়িয়ে ধরো। খুব শীত করছে। 

মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। মাথায়, মুখে হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, শুধু আজকের রাতটুকু কষ্ট করো মা। কাল সকালে আমি ওপাড়ায় যাবো। ওপাড়ার চৌধুরীর বড় ছেলে শহর থেকে এসেছে। ম্যালা কম্বল এনেছে। কাল সকালে কম্বল বিতরণ করবে। যদি একটা কম্বল পাই, তাহলে আমাদের আর কোনো শীত থাকবে না। আমরা অন্তত রাতটুকু শান্তিতে ঘুমাতে পারব।

সমিজান মাকে আরো জোরে জরিয়ে ধরল। 

সমিজানের বাবা ছিল ধনী ব্যক্তি। গ্রামে তাদের অনেক জায়গাজমি ছিল। ভালো আবাদ ছিল। সংসারে কোনো অভাব ছিল না। তারা ছিল সুখী পরিবার।

এ বছর বর্ষায় পদ্মা নদী রাক্ষুসী রূপ ধারণ করে। গোগ্রাসে একের পর এক আবাদি জমি গিলতে থাকে। গিলে সমিজানের বাবা আইনালের সব আবাদি জমি, ভিটেমাটি। সব হারিয়ে আইনাল দিশেহারা হয়ে পড়ে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় যায়। ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালায়। কিন্তু বিধিবাম। ভাগ্যের কী নির্মমখেলা! কয়েক দিন পরই সে রোড অ্যাক্সিডেন্ট করে মারা যায়। হতবিহ্বল সালেহা একমাত্র মেয়ে সমিজানকে নিয়ে গ্রামে ফিরে আসে। বাবার এক টুকরো জমিতে একটি খুপড়ি ঘর তোলে। মেয়েকে নিয়ে থাকে।

সালেহা ভোরেই ঘুম থেকে ওঠে ওপাড়ায় চৌধুরীর বাড়িতে যায়। গিয়ে দেখে মানুষের লম্বা লাইন। সে চুপি চুপি লাইনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। 

লাইনে দাঁড়ানো একে একে সবাইকে কম্বল দেয়া হয়। সালেহাও একটি কম্বল পায়। কম্বল পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে মনে মনে বলে, মা সমিজান, আমি কম্বল পেয়েছি। এখন যতই শীত পড়ুক আমাদের আর ভয় নেই। ঠাণ্ডা আমাদের স্পর্শ করতে পারবে না। এই বলে সে দ্রুত বাড়ির পথে পা বাড়ায়। 

 বাড়ি ফিরে চমকে ওঠে সালেহা। বাড়িতে অনেক মানুষের জটলা। সালেহার বুকটা ধকধক করে ওঠে। আরো দ্রুত পা বাড়ায়। মানুষের জটলা ঠেলে ভেতরে ঢুকে। দেখে মেয়ে সমিজান মাটিতে শুয়ে আছে। তার পুরো শরীর আগুনে দগ্ধ।

সালেহা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। চিৎকার করে বলে, কী হয়েছে আমার মেয়ের? ওর শরীর আগুনে পোড়া কেন? ও কথা বলছে না কেন? 

পেছন থেকে একজন বলল, ও ঘুম থেকে উঠে আগুন পোহাচ্ছিল। অমনি কিভাবে যেন গায়ে আগুন লেগে যায়।

সালেহা বলল, নাহ, আমার সমিজানের গায়ে আগুন লাগতে পারে না। তারপর সে সমিজানের মাথা ধরে ঝাঁকাতে লাগল। এই সমিজান, মা, ওঠ, ওঠ মা। এই দ্যাখ, আমি তোর জন্য কম্বল এনেছি। শীতের মোটা কম্বল। বাইরে শীত করছে। চল ঘরে যাই। ঘরে গিয়ে মোটা কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকি। তা হলে আর কোনো শীত করবে না। 

পেছন থেকে একজন বলে উঠলেন, সালেহা, সমিজান আর কোনো দিন ঘুম থেকে উঠবে না। ও বেঁচে নেই। মারা গেছে। 

সেতাবগঞ্জ, দিনাজপুর।

 


আরো সংবাদ



premium cement