২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ভালোবাসার সৌধ তাজমহল

-

তখন ভারতে লেখাপড়া করি। দেশ থেকে দুলাভাই এলেন এখানের পর্যটনকেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখতে। তার সাথে এলেন আমাদের গ্রামেরই আরো কয়েকজন। দিল্লির নিজামুদ্দিনে তাদের সাথে সাক্ষাৎ হলো। অনেক দিন পর চেনা প্রিয়মুখগুলো দেখে মনে আনন্দের ঢেউ খেলে গেল। তাদের চেহারায় যেন মা-বাবা আর প্রিয় গ্রামবাংলার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলাম। দুলাভাই আগেই বাসের টিকিট কেটে রেখেছিলেন। যথাসময়ে বাস এলে চেপে বসলাম। ভোর ৫টায় বাস ছাড়ল তাজমহলের উদ্দেশে। ঘন গাছগাছালির ভেতর দিয়ে বাস চলতে থাকল দ্রুতগতিতে। বাইরে হালকা কুয়াশা। শিশিরবিন্দু ঝরে ঝরে পড়ছে লতা-পাতার গা বেয়ে। দিনেরবেলা প্রচুর গরম পড়লেও এখন শীত শীত লাগছে খানিকটা। গায়ে চাদর জড়িয়ে বাইরের দৃশ্যে মনোযোগী হলাম। সূর্যটা কেবলই পূর্ব দিগন্তে উঁকি দিয়েছে। হালকা সূর্যরশ্মি গাছগাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে প্রবেশের চেষ্টা করছে। কুয়াশামাখা রোদ্দুরের অনুপম দৃশ্য আমাকে মোহাবিষ্ট করে রাখল। ভোরের পাখিদের কিচিরমিচির রবে মনটা আরো খুশি হয়ে উঠল। ঘন জঙ্গল ছেড়ে একসময় বেরিয়ে এলাম খোলা প্রান্তরে। দিগন্তজোড়া খালি মাঠ। রাখাল ছেলের গরু-মহিষ চড়ানোর দৃশ্য চোখে পড়ল হঠাৎ। বিশাল সে মাঠের বুক চিরে বয়ে গেছে ছোট্ট একটি নদী। বহুদূর গিয়ে যেন নদীটি মিশে গেছে আকাশের নীলে। আরেকটু এগোতেই রাস্তার দু’পাশে নজরে এলো সুন্দর সুন্দর ফুলের বাগান। নানা রঙের নাম না জানা ফুল ফুটে আছে গাছে গাছে। প্রজাপতিরা উড়ছে ফুলে ফুলে। মৃদু বাতাসে দুলছে কান্তিমতি ফুলগুলো। ক্যামেরাবন্দী করে নিলাম সুন্দর সে দৃশ্য। তাজমহলে যখন পৌঁছলাম, তখন সূর্যটা মাথার উপরে। প্রচণ্ড গরমে সবাই ক্লান্ত। বাস থেকে নেমে অটোরিকশায় চড়ে তাজমহলের বাইরের গেটে পৌঁছলাম। টিকিট কেটে লম্বা লাইন আর নিরাপত্তাকর্মীদের কড়া নজরদারি পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। নারী-পুরুষ আর বিদেশী পর্যটকদের জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন লাইন। তাজমহলের ভেতরের প্রধান ফটকের বাইরে একটুখানি খোলা জায়গা। সেখানে দাঁড়িয়ে আমাদের ট্যুরিস্ট গাইড ভেতরের স্থাপত্য এবং দর্শনীয় স্থানগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলেন। কিছু নিয়মকানুনও জেনে নিলাম তার কাছ থেকে। ভেতর ঢুকতে বিশাল এই ফটকের নিচ দিয়ে যেতে হয়। এর উচ্চতা প্রায় একশ’ ফুট। উপর দিকে রয়েছে কয়েকটি ছোট ছোট গম্বুজ। অনিন্দ্য সুন্দর ফটকটি তাজমহলের দর্শনীয় স্থানগুলোর একটি। এর দু’পাশে এবং উপরে সাদা মার্বেল পাথর খোদাই করে লিপিবদ্ধ হয়েছে কুরআনের বিশেষ কয়েকটি আয়াত। দাঁড়িয়ে তেলাওয়াত করলাম সেগুলো। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল শত শত বছর আগের ভালোবাসার নিদর্শন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অনন্য সৌধটি। যা ভারত উপমহাদেশে মুসলিম ঐতিহ্যের অমূল্য নিদর্শন। এর সবক’টি ভবনের নির্মাণশৈলী মুঘল স্থাপত্যের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়। ট্যুরিস্ট গাইড স্থাপত্যগুলো দেখাতে দেখাতে বলে চললেন সে ইতিহাস। সময়টা তখন ১৬১২ সাল। মুঘল সম্রাট শাহজাহান নিজ পছন্দেই বিয়ে করেন ১৫ বছরের পরমা সুন্দরী আরজুমান্দ বেগমকে। ভালোবেসে তার নাম দেন মমতাজ মহল। মমতাজ উনিশ বছরের বৈবাহিক জীবনে চৌদ্দ সন্তান গর্ভে ধারণ করেন। সর্বশেষ সন্তান প্রসবকালে ১৬৩১ সালে তিনি মারা যান। সেই শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েন সম্রাট শাহজাহান। পরে স্ত্রীর স্মরণে ১৬৩২ সালে যমুনা নদীর তীরে একটি সৌধের নির্মাণকাজ শুরু করেন। দীর্ঘ ২২ বছর বহু কষ্ট-সাধনার পর ১৬৫৩ সালে শেষ হয় এর নির্মাণকাজ। প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক এতে কাজ কশ্রণ এবং প্রায় এক হাজার হাতি মার্বেল পাথর ও অন্যান্য সামগ্রী বহন করে।
তাজমহল নির্মাণের জন্য পাঞ্জাব থেকে আনা হয় স্বচ্ছ মার্বেল পাথর, চীন থেকে সবুজ পাথর, তিব্বত থেকে স্বচ্ছ নীল পাথর এবং শ্রীলঙ্কা থেকে নীলমণি। তা ছাড়া ভারত, পাকিস্তান, পারস্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় আটাশ ধরনের মূল্যবান পাথর দিয়ে তৈরি করা হয় এই অনন্য স্থাপত্য। এর ঠিক সামনে রয়েছে লম্বাটে একটা পানির হাউজ। যার মধ্যে ভেসে ওঠে তাজমহলের প্রতিচ্ছবি। সে দৃশ্যের ছবি তুলে নিলাম কয়েকটি। এর দু’পাশে দুটো পানির ফোয়ারা। আশপাশে গাছগাছালির ঘন ছায়ায় বেড়ে উঠেছে সারি সারি ফুলের বাগান। অনিন্দ্য সুন্দর সে দৃশ্য সহজেই দর্শকের মন কাড়ে। ডান দিকের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলাম। নজর পড়ল পূর্বপাশে বিস্ময়কর কারুকার্য খচিত বিশাল মসজিদে। লাল বেলে পাথরে নির্মিতি মসজিদটির নির্মাণকাজ তাজমহলের সাথে শুরু হয়ে শেষ হয় ১৬৪৩ সালে। ৫৬৯ জন মুসল্লির ধারণক্ষমতাসম্পন্ন মসজিদটিতে এখনো নিয়মিত নামাজ আদায় হয়। মসজিদ থেকে বেরিয়ে এলাম তাজমহলের সামনে। চার পাশে চারটি উঁচু মিনার এবং মাঝখানে সুবিশাল গম্বুজ। এটিই তাজমহলের মূল আকর্ষণ। গম্বুজের সর্বোচ্চ চূড়ায় রয়েছে কাঁসার দণ্ড। আঠারো শতকের আগে এটি স্বর্ণখচিত ছিল। পুরো তাজমহল ১৮০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। প্রধান গম্বুজটি ২১৩ ফুট উঁচু এবং ৬০ ফুট চওড়া। চার পাশে চারটে মিনারের প্রতিটির উচ্চতা ১৬২.৫ ফুট। এর মূল ফটকেও সাদা মার্বেল পাথরে খোদাই করে লিপিবদ্ধ হয়েছে কুরআনের অসংখ্য আয়াত। এ ছাড়াও অন্যান্য সাদা মর্বেল পাথর খোদাই করে আশ্চর্য সব কারুকার্য ও চিত্র আঁকা হয়েছে। শত শত বছর আগে কিভাবে কোন শিল্পী এগুলো করল, সেটিই বিস্ময়কর। ছোট দরোজাটি দিয়ে ভেতর ঢুকলাম। আবছা অন্ধকার। ভেতরে লাইট জ্বালানো ও ছবি তোলা নিষেধ। গম্বুজের ঠিক মাঝ বরাবর নিচে সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজের সমাধি। সমাধিটি একটি বর্গাকার বেদিকার ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। অন্য পাশে সম্রাটের অন্যান্য স্ত্রীর কবর। কিছু ওজিফা পাঠ করে তাদের মাগফিরাতের দোয়া করলাম। পেছন দিকের দরোজা দিয়ে বেরোতেই আরেক সুন্দরের মুখোমুখি হলাম। কলকল গ্রোতে নিরবধি বয়ে চলছে যমুনা নদী। ওপারটায় বিশাল খালি প্রান্তর। হু হু করে বাতাশ বইছে গা ছুঁয়ে। সাদা বেলে পাথরের বেসমেন্টে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখে মনটা প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল। তাজমহলের এ দৃশ্যটিই আমার কাছে বেশি সুন্দর মনে হয়েছে। নির্মাণের পর থেকেই তাজমহল বহু পর্যটককে আকর্ষণ করেছে। ১৯৮৩ সালে তাজমহল ইউনেস্কো থেকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। পর্যটকের অধিক্যের কারণে এর দক্ষিণ পাশে ছোট শহর তাজগঞ্জ বা মুমতাজাবাদ গড়ে তোলা হয়েছে।
বর্তমানে তাজমহলে প্রতি বছর বিশ-ত্রিশ লাখ পর্যটক আসেন, যার মধ্যে প্রায় দুই লাখ পর্যটক বিদেশী। সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসেন শীতকালে। বায়ুদূষণকারী যানবাহন তাজমহলের কাছে আসা নিষেধ। পর্যটকদের তাই গাড়ি রাখার স্থান থেকে হেঁটে বা অটোরিকশায় চড়ে তাজমহলে আসতে হয়।
সূর্যটা এখন হলদে রঙ ছড়িয়ে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। সন্ধ্যায় পাখিদের কাকলিতে মুখরিত পুরো তাজমহল এলাকা। বাইরে এসে হালকা নাশতা করে বাসে চড়ে চললাম আমাদের গন্তব্যে।


আরো সংবাদ



premium cement
সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন ভুটানের রাজা জাতীয় দলে যোগ দিয়েছেন সাকিব, বললেন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই কারওয়ান বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয় এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত বদরের শিক্ষায় ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : সেলিম উদ্দিন ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু : বিশ্বব্যাংক

সকল