২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পতাকাওয়ালা দাদু

-

বাবা আমাকে কাল সকালে ৫০ টাকা দিও তো। আমাদের স্কুলে কালকে একজন পতাকাওয়ালা দাদু আসবে। স্কুলের স্যার-ম্যাডামরা বলেছেন, সবাই যেন ৫০ টাকা করে নিয়ে স্কুলে যাই। ছোট তানফির কথা শুনে আমি অবাক হলাম! প্রশ্ন করলামÑ পতাকাওয়ালা দাদু কে? তানফি এবার বড় ওয়ানে পড়ে। আমার কথা শুনে বললÑ বাবা, পতাকাওয়ালা দাদু হলো একজন অসুস্থ মানুষ। ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারে না। ক্লাসে স্যার-ম্যামরা বলেছেন, ওই দাদু নাকি মুক্তিযোদ্ধা! দেশ স্বাধীনের সময় যুদ্ধ করেছেন। দাদুর এখন অনেক বয়স। তাই কোনো রকম কাজ করতে পারেন না। আবার মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করতেও বিবেক বাধা দেয়। দাদুর ঘরসংসার বলতেও কিছু নেই। দেশ স্বাধীনের যুদ্ধের সময়, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাতে দাদুর পরিবারের সবাই মারা গেছে। বাবা, তুমি আমাকে কাল সকালে টাকা দিও কিন্তু। সকালে তানফি আমার কাছে এলো স্কুলড্রেস পরে। গলা জড়িয়ে ধরে বলল, বাবা আমার ৫০ টাকা দাও। আমি তানফিকে বললামÑ মামণি আজ আমিও তোমার সাথে তোমাদের স্কুলে যাবো। পতাকাওয়ালা দাদুর সাথে আমিও দেখা করব।
আমার কথা শুনে তানফি ময়নাপাখির মতো নেচে উঠল। সকালের খাবার খেয়ে তানফিকে নিয়ে চললাম ওদের স্কুলের পথে। একটু পরে স্কুলে উপস্থিত হয়ে, স্যারের কাছে জানতে পারলামÑ কিছুক্ষণ পর চলে আসবে পতাকা বিক্রি করা সেই দাদু। আমার যেন অপেক্ষার পালা শেষ হয় না! দেখতে দেখতে হঠাৎ চেয়ে দেখি, একজন বয়স্ক লোক। হাতে অনেকগুলো লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে তানফিদের স্কুলে ঢুকল। আমার বুঝতে বাকি থাকল না, এই লোক হলেন পতাকাওয়ালা দাদু। দাদুকে দেখে স্কুলের সব ছাত্রছাত্রী চিৎকার করে বলতে লাগল। পতাকাওয়ালা দাদু এসেছে...।
আমার হাতের আঙুল ছেড়ে দিয়ে তানফিও ছুটল।
সবাই মিলে দাদুকে ঘিরে ধরল। স্কুলমাঠের এক পাশে, দাদু সবাইকে নিয়ে বসল। স্কুলের বড় স্যার উপস্থিত হয়ে তানফিদের উদ্দেশে বললÑ এই হলো তোমাদের পতাকাওয়ালা দাদু। আজ তোমাদের কাছে এই দাদু তার জীবনের গল্প এবং মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলবে। তোমরা সবাই মন দিয়ে শুনবে; কেউ কথা বলবে না। গল্প বলা শেষ হলে আমরা সবাই এই দাদুর কাছ থেকে একটা করে লাল-সবুজের পতাকা কিনে নেব। স্যারের কথা শুনে সবাই বলে উঠলÑ জি স্যার। আমিও বসলাম তানফিদের পাশে।
এবার গল্প বলা শুরু করল পতাকাওয়ালা দাদু। দাদু বলতে লাগল, তখন আমার উঠতি বয়স। ২২-২৩ বছর চলছে। প্রতিদিনের মতো সেদিন রাতের খাবার খেয়ে যে যার মতো করে ঘুমিয়ে পড়ছি। হঠাৎ করে মাঝরাতে গ্রামের মানুষের আর্তচিৎকারে সবার ঘুম ভেঙে যায়। মসজিদের মাইকে ঘোষণা করা হয়Ñ গ্রামে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঢুকেছে। কিছু বুঝে ওঠার আগে রাতের আকাশজুড়ে প্রচণ্ড শব্দে বুলেট, গুলি ছুড়তে থাকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। কিচির-মিচির শব্দ করে বন থেকে উড়ে চলে হাজারো পাখি। গ্রামের যেদিক চোখ যায়, তাকিয়ে দেখি আগুন আর আগুন। সেদিন রাতের আঁধারে গ্রামের সব ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। নির্বিচারে হত্যা করে শত শত মানুষ। ঘুমন্ত মানুষকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। হাত-পা বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে, বুলেটের আঘাতে ঝাঁজরা করে শত শত মানুষের বুক। লাল লাল তাজা রক্তর স্রোত বয়ে যায় গ্রামজুড়ে।
গর্ত থেকে বের হয়ে বাবা-মা, ভাই-বোন সবাইকে খুঁজতে থাকি। আশপাশে তাকিয়ে দেখি শত শত লাশের মিছিল। প্রতিটি লাশ আগুনে পোড়ানো, নয়তো বুলেট-গুলির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত দেহ। দেখে চেনার উপায় নেই কে, কার বাবা-মা, ভাই-বোন। শত চেষ্টা করেও সেদিন আমার পরিবারের কারো লাশ খুঁজে পাইনি। এমনকি আজ অবধি খুঁজেও কারো জীবিত থাকার খবর পাইনি। সেদিন রাতের আঁধারে পালিয়ে চলে এলাম পাশের গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের দলে। এমন করে কেটে গেল কয়েক মাস। সারা দিন জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে। রাতের আঁধারে গুঁড়িয়ে দিয়েছি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ঘাঁটি। একদিন সকালে সূর্যের স্বচ্ছ আলোয়, বেতার, টেলিভিশনে ভেসে এলো আমাদের কুড়িগ্রাম জেলা হানাদার তথা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী মুক্তের খবর।
চার দিকে খুশির জোয়ার বইতে শুরু করল। দিনে দিনে, বাংলাদেশের সব এলাকা, শত্রুমুক্তের খবর চলে আসতে লাগল। এমন করে একদিন বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হলো। বাংলাদেশের আকাশ-বাতাসে উড়তে লাগল লাখো শহীদের রক্তে পাওয়া লাল-সবুজের পতাকা। দাদুর গল্প শুনে সবাই যেন চলে গিয়েছিল ’৭১-এ, মুক্তিযুদ্ধের দিনে। শেষে দাদু বললেন, দেশ স্বাধীনের পরে আর বিয়ে-সংসার করা হয়নি। পড়ালেখাও তেমন একটা জানা নেই। দাদু মনে আক্ষেপ নিয়ে বলতে থাকেন। যে স্বপ্ন আর আশা নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি। আজ তার একটুও পূর্ণ হয়নি। শেষে দাদু বললেন, আগে রিকশা চালাতেন ঢাকার বুকে। তবে হঠাৎ একদিন সড়ক দুর্ঘটনায় বাঁ পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা পান। গরিব মানুষ বলে ঠিকমতো চিকিৎসাও করাতে পারেননি। যে পতাকার জন্য, যে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন উপায় না পেয়ে, সেই লাল-সবুজের পতাকা আজ এখানে তো কাল ওখানে ফেরি করে বিক্রি করেন। ঘরসংসার না থাকার কারণে বাজারের কোনো দোকানের বারান্দায়। নয়তো কোনো স্কুলের বারান্দায় রাত কাটিয়ে দেন। দাদুর এমন গল্প শুনে, অশ্রুতে চোখ ভরে উঠল। স্কুলের স্যার-ম্যামরা সবাই বসে সিদ্ধান্ত নিলেনÑ স্কুলের পাশে ছোট একটা দোকান করে দেবেন। আর দাদু সেই দোকান চালিয়ে আয়রোজগার করে খাবেন।


আরো সংবাদ



premium cement
শিশুদের বিকাশে অটিজম অভিভাবকদের সচেতনতা ফরিদপুরে মন্দিরে আগুন : দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় বিএনপির তদন্ত কমিটি নেতাদের মুক্তির দাবিতে রিজভীর নেতৃত্বে নয়াপল্টনে বিএনপির মিছিল বৃষ্টির জন্য দেশবাসীর প্রতি ইস্তিস্কার নামাজ আদায়ের আহ্বান আমিরে জামায়াতের সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে চুক্তি স্বাক্ষর করল তুর্কি, ইরাক, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ঢাকায় ‘হিট স্ট্রোকে এক ব্যক্তির মৃত্যু শ্যামবাজার ঘাটে লঞ্চে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৪ ইউনিট ‘আমার শিশু মেয়েটির যে সর্বনাশ সে করেছে’ বান্দরবানের ৩ উপজেলায় নির্বাচন স্থগিত চুয়াডাঙ্গায় বৃষ্টির জন্য ইস্তিস্কার নামাজে মুসুল্লিদের ঢল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের চাবিটা মনে হয় পার্শ্ববর্তী দেশকে দিয়েছে সরকার : রিজভী

সকল