২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ছুটি

চারাগল্প
-

হেমন্তের সকালে রোদের আলোয় ঘাসের ডগায় খেলা করছে শিশির কণা। দূরের কোথাও উড়ে চলছে শালিক জোড়া। মাঠের পরে মাঠজুড়ে সোনালি ধানের ক্ষেত। একটু একটু করে রোদের তেজ বাড়ছে। কাস্তে হাতে আইলি পথ ধরে ক্ষেত ভরা সোনালি ধান কাটতে মাঠের বুকে চলছে আলম মিয়া। আলম মিয়ার নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবার দুই মেয়ে আর বউকে নিয়ে। ছোট্ট থেকে অভাবের সাথে পরিচয় আলম মিয়ার। ইচ্ছে থাকলেও অভাবের কারণে পড়ালেখা বেশি দূর এগিয়ে নিতে পারেনি। আলম মিয়ার বয়স যখন ২০ বছর। তখন আলম মিয়ার বাবা মৃত্যুশয্যায়! একদিন আলম মিয়াকে ডেকে বলল, বাবারে তোর বিয়ে দিয়ে বউমাকে দেখার খুব ইচ্ছে আমার। মৃত্যুশয্যায় থাকা বাবার কথা রাখতে, অল্প বয়সে বিয়ে করে আলম মিয়া। কিছু দিন পর আলম মিয়ার বাবা মারা যায়! বাবা মারা যাওয়ার পর, আলম মিয়ার জীবন জুড়ে নেমে আসে কষ্টের পাহাড়।
যেদিকে তাকায় দু’চোখে জুড়ে যেন অন্ধকার!
বিয়ের এক বছরের মাথায় আলম মিয়ার ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় প্রথম মেয়েসন্তান। আলম মিয়া কিছু বুঝে ওঠার আগে, দুই বছর পরে আবার জন্ম নেয় আরো একটা মেয়েসন্তান। দুই মেয়ের জন্মের পর থেকে, নানা রকম অসুখ লেগে থাকে সব সময়। ডাক্তার দেখানো হলো। ডাক্তার আলম মিয়াকে বলে, অল্প বয়সে বিয়ে এবং সন্তান জন্ম নেয়ার কারণে নানা রকম অসুখে সব সময় অসুস্থ থাকে সন্তান ও স্ত্রী। ভাগ্যকে মেনে নিয়ে, দুই হাতের ওপর ভর করে। দিনের পর দিন কষ্ট করে আলম মিয়া। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করে।
খেয়ে-পরে কিছু টাকা জমিয়েছে। সেই টাকা দিয়ে কিছু ফসলি জমি বন্ধক নিয়েছে। আলম মিয়া মনে মনে পরিকল্পনা করে! এবার জমির ধান বিক্রি করে বড় মেয়ের বিয়ে দেবে। গরিব মানুষ বলে ভালো কোনো সম্বন্ধ আসে না মেয়ের জন্য। যদিও দু-একটা আসে তাও আবার ম্যালা টাকা যৌতুক দাবি করে। আজকাল যৌতুক ছাড়া গ্রামের কোনো মেয়ের বিয়ে হয় না। কী যুগ যে এলো! সোনালি ধানক্ষেতের পাশে বসে নানা রকম কথা ভাবে আলম মিয়া। বড় মেয়েটার বয়স প্রায় ২০ বছর হতে চলল। গ্রামের সবাই আজেবাজে কথা বলে এই নিয়ে। উঠতি বয়সের ছেলেরা লোভাতুর দৃষ্টি নিয়ে তাকায় বাড়ি দিকে। কখন যে কী দুর্ঘটনা ঘটে মেয়ের কপালে। আলম মিয়া কাস্তে হাতে নিয়ে ধান কাটায় মন দেয়। এবার ধান চাষ করতে গিয়ে, তেল, সার, কীটনাশক ওষুধ কিনতে অনেক টাকা চড়া সুদে ঋণ নিয়েছে। পাওনাদারদের বলছে নতুন ধান ঘরে উঠলে, বিক্রি করে টাকা দেবে।
দেখতে দেখতে রোদের তেজ আরো বেড়ে গেল। শুকিয়ে গেল ঘাসের ডগার শিশির কণা। আলম মিয়া সূর্যের দিকে তাকায়; অনেক বেলা হয়েছে। খুব ক্ষুধা পেয়েছে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। বাড়ি আসার পথে রাস্তার মোড়ে মজনু মিয়ার চায়ের দোকানে মানুষের ভিড় দেখে, কৌতূহল বারে ভিড় ঠেলে সামনে যায়। সবার চোখ টিভিতে আলম মিয়াও শোনার চেষ্টা করে টিভিতে কী বলছে! একটু পরপর বড় বড় অক্ষরে টিভির নিচে শিরোনাম ভাসছে। সারা দেশে ধানের বাম্পার ফলন। তবে ধানের দাম একদম নি¤œমুখী। কৃষকেরা হতাশ। এক মণ ধান বিক্রি করে, খরচের টাকাও উঠাতে পারছেন না কৃষকরা। এ দিকে বাজারজুড়ে চলছে পেঁয়াজের হাহাকার। দিনে দিনে বেড়ে চলছে, শাকসবজিসহ নিত্যপণ্যের দাম। টিভির শিরোনাম পড়ে আলম মিয়ার শরীর ঘামতে শুরু করে। তাড়াতাড়ি করে বাড়ি চলে আসে। আলম মিয়ার বউ, স্বামীর পাশে বসে। একটু ঝুঁকে আদুরে গলায় বলেÑ ওগো শুনছো? বড় মেয়ের জন্য একটা ভালো সম্বন্ধ এসেছে। ছেলে ঢাকায় চাকরি করে। ছেলের পরিবার অনেক ভালো। ঘটক বলেছে, একটা মোটরবাইক দিলেই চলবে যৌতুক হিসেবে। এবার কিছু একটা করো! এই সম্বন্ধটা ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না আমাদের। মেয়ে অনেক বড় হয়েছে, গ্রামের মানুষ মুখে মুখে নানা রকম কথা বলে। বউয়ের কথা শুনে, ভাতের গ্রাস মুখে না দিয়ে পানি ঢেলে হাত ধোয় আলম মিয়া। মনে মনে ভাবে কত স্বপ্ন ছিল এই সোনালি ধান নিয়ে! অথচ তার কিছুই পূরণ হবে না। মেয়েটাও বড় হয়ে যাচ্ছে। ছোট্ট মেয়েটার সামনে এসএসসি ফাইনাল পরীক্ষা। পাওনাদাররাও দু-এক দিন পর আসবে টাকার জন্য। আলম মিয়া আর কিছু ভাবতে পারে না। সব ভাবনাকে আজীবনের জন্য ছুটি দিতে আলম মিয়া বাড়ির বাইরে চলে আসে।
দুর্গাপুর, কুড়িগ্রাম

 


আরো সংবাদ



premium cement