২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

জীবন নদীর আঁকাবাঁকা ঢেউ

-

যাচ্ছি বন্ধুর বাসায় দাওয়াত খেতে, ধানমন্ডি সাতাশ। শরীরের পোশাকে বড়লোকির ভানধরা চটকদার বিজ্ঞাপন। জিন্সের প্যান্টের সাথে খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি। দেখলে বোঝার উপায় নেই, ত্রিশ টাকা বাঁচানোর জন্য সকালের নাশতা খাইনি। খিদে মিটিয়ে নিয়েছি বেশি করে ঘুমিয়ে। জানি এই টাকা দিয়ে দালানকোঠা উঠবে না; আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়াও অসম্ভব। তবু কেন এমন করলাম? সত্যি তা আমার অজানা।
লেকের পাড় দিয়ে হাঁটছি। দূরে তাকিয়ে দেখি কলেজপড়ুয়া কয়েকটি ছেলে সিগারেট টানছে। এটা অবাক হওয়ার মতো ঘটনা নয়। এখানে এর চেয়েও বড় কিছু ঘটে। আচ্ছা, ঘটে বলেই কি আমরা মেনে নিই? প্রতিবাদ করার এতটুকু দায়বদ্ধতা কাজ করে না আমাদের? কাজ করে, তবে বাস্তবায়ন হয় না। আমার এখন ইচ্ছে করছে সদ্য কলেজে ওঠা ছেলে কয়টাকে থাপড়ে সিগারেট খাওয়ার স্বাদ জনমের মতো ভুলিয়ে দিই। কিন্তু অচেনা শহর। পাল্টা আক্রমণের সময় কেউ পাশে থাকবে না।
দেখেও না দেখে খানিকটা আনমনা হলাম। ছেলে দুটোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পেলামÑ ‘দূর, এ জীবন আর ভালো লাগে না। বাপমরা একটা ছেলে খামচিয়ে কতটুকু আর এগোতে পারে? তার ওপর বোনের বিয়ে দেয়ার দায়িত্ব। উফ! আরেকটা সিগারেট ধরা তো।’ তাতেও খুব একটা অবাক হইনি। সবারই কষ্ট থাকে, আছেও। তাই বলে সিগারেট খেতে হবে? নষ্ট হয়ে যেতে হবে? তা তো হতে পারে না। তবে থাপড়ানোর পরিবর্তে ছেলে দুটোকে এখন বুকে জড়াতে ইচ্ছে হলো। যেন বলি, আমারও তো কষ্ট রাখার জায়গা নেই!
বন্দুর বাসায় এসে একই সাথে ঈর্ষা ও বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলাম। আমার সাথে আরো তিন বন্ধু। দাওয়াতের উপলক্ষ হলো, বন্ধু মেহেদি নতুন দামি একটা বাইক কিনেছে। বাইরে ট্রিট দেয়ার কথা থাকলেও আন্টির আবদারÑ নিজ হাতে রান্না করে আমাদের খাওয়াবেন। সুনিবিড়, গোছানো বাসা। মনোরম পরিবেশ। কিন্তু ভেতরে গিয়ে টের পেলাম উত্তাপ। বন্ধুর বাবা আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলছেনÑ ‘ছোটবেলায় বাপ-মা হারানো এই আমি অনেক কষ্টে এসব জোগাড় করেছি অযথা নষ্ট করার জন্য? তা ছাড়া বাইকের এক্সিডেন্ট খুবই মারাত্মক।’
দুঃখ প্রকাশ করে বন্ধু বাইরে ট্রিট দেয়ার কথা বলল। আমরা ওকে বুঝিয়ে বাসায় রেখে এলাম। বাকি বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি হাঁটতে লাগলাম ফুটপাথ ধরে। যেকোনো ঘটনার রেশ আমার মাথায় অনেকক্ষণ ঘুরপাক করতে থাকে। এখনো করছে। সেজন্য মাথায় টনটনে ব্যথা। এক কাপ কড়া লিকারের চা খেলে ঠিক হয়ে যেত। কিন্তু পেটে ক্ষুধা। আগে কিছু খেয়ে নিতে হবে।
আমার বন্ধুভাগ্য খুব ভালো। আমি দৈন্যদশায় হাবুডুবু খেলেও আমার বন্ধুরা সব টাকার জাহাজ। তাদের সাথে অবশ্য টাকার জন্য বন্ধুত্ব হয়নি; টাকাওয়ালা সোসাইটির ব্যাপারে আমার সম্যক ধারণা দরকার। টুকটাক লেখালেখি করি। সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে জানা লেখকের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
তবে আমার ভাগ্য আরেকটু সুপ্রসন্ন যে, আরিয়া নামে টাকাওয়ালা এক প্রেমিকা জুটেছে কপালে। আমি বলতে অজ্ঞান, দু’চোখে আমাকে ছাড়া কিচ্ছু দেখে না। ওর কথা ভাবতে গেলেই শরৎচন্দ্রের নায়িকা, কালবেলার মাধবীলতা, কিংবা হুমায়ূন আহমেদের বাকের ভাইয়ের জন্য নিবেদিতপ্রাণ মুনার কথা মনে পড়ে। পার্থক্য হলো, আমার প্রেমিকা ওদের চেয়েও শতগুণ বেশি ভালোবাসে আমায়।
ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলÑ ‘কোথায় আছো?’ আমি বড়লোক প্রেমিকের মতো করে উত্তর দিলামÑ ‘ধানমন্ডি সাতাশের ইউনিক রেস্টুরেন্ট ইউনিমার্টে।’ উত্তর দিয়ে কামড় বসালাম তৃতীয় সিঙ্গাড়ায়। ইউল্যাবের সামনের এই দোকানে ভালো মানের সিঙ্গাড়া বানায়। ভেতরে বসার মতো জায়গা নেই। অন্যদের মতো আমিও প্লেট হাতে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খাচ্ছি।
আশপাশে আরিয়া আছে কি না কে জানে। থাকলে থাকতেও পারে। সুপারম্যানের মতো হঠাৎ উদয়কাণ্ড তার অন্যতম গুণ। সিঙ্গাড়ার বিল মিটিয়ে পেছনে ঘুরতেই দেখি আরিয়া। হাতে কোক। আমার দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বললÑ ‘তোমাদের বেশি দামি সিঙ্গাড়িত ইউনিমার্টে নিশ্চয়ই কম দামি এই জিনিসটা নেই। তাই নিয়ে এলাম।’
জঙ্গলবাড়ি, করিমগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ


আরো সংবাদ



premium cement